পথনাটিকা – চোর |
পথনাটিকা
চোর
(এক বিকেল। বছর চল্লিশের এক যুবক জনবহুল পিচ-রাস্তার ধারে ফুটপথে এক চায়ের দোকানে চা খেতে এল। পেছনে সাইকেল রেখে সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে গিয়ে বসল। অখেয়ালে সাইকেলে তালা দিতে ভুলে গেছিল। যুবক হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। তারই প্রায় সমবয়সি এক চোর সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সাইকেলটা নিয়ে ছুটে পালাচ্ছিল। নিমেষে যুবকের সম্বিত ফিরে আসতেই – )
যুবকঃ চোর, চোর, চোর। আমার সাইকেল নিয়ে পালাচ্ছে। চোর, চোর, সাইকেল চোর। ধরো ওকে। চোর, চোর। (কিছুটা দৌড়ে যাবে)
(বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসা দু’জন পথচারী চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়াবে। প্রস্তুতি নিয়ে চোরকে ধরে ফেলবে)
পথচারী একঃ ধরেছি, আর পালাতে পারবেনা।
পথচারী দুইঃ ব্যাটা সাইকেল চুরি করে পালাচ্ছিল। দেখ্ এবার – চুরির সাজা কেমন।
পথচারী একঃ মার্, শালাকে মার্। (মারতে উদ্যত)
চোরঃ (হাতজোড় করে) মেরো না দাদা, আমাকে মেরো না। আমি চোর নই।
যুবকঃ (ইতিমধ্যে প্রায় কাছে চলে এসেছে। হাত তুলে মারতে নিষেধ করে) এই থাম্, মারবি না। একদম মারবি না।
পথচারী দুইঃ আরে ভাই, তোমারই সাইকেল চুরি করে পালাচ্ছিল। তুমিই চোর চোর বলে চিৎকার করলে, আবার এখন তুমিই মারতে মানা করছো?
যুবকঃ হ্যাঁ,করছি। ভেরি ইন্টারেষ্টিং। শুনলে না – বলল, ‘আমি চোর নই’।
(গণ্যমান্য, বয়োজ্যেষ্ঠ দুজন চা খাচ্ছিল। তারাও এতক্ষণে চলে এসেছে)
মহফুজ আলমঃ হ্যাঁ, ব্যাপারটা অত্যন্ত চমকপ্রদ। ও যখন নিজেই বলছে – আমি চোর নই, তখন ওর কথা আমাদের শুনতে হবে।
বিজয়কৃষ্ণঃ এই যে ছোকরারা, তোমরা উত্তেজিত হইও না। মহফুজ সাহেব যখন বলছেন, তখন ছেলেটার কথাগুলো আমাদের শোনা দরকার। (ছেলেটার দিকে তাকিয়ে) এই যে বেচারা ছেলে, আমি কথা দিচ্ছি, কেউ তোমাকে মারবে না। তুমি এখানে নির্ভয়ে বসো, আর তোমার কথাগুলো খুলে বলো।
(দু’জন একটি বেঞ্চ নিয়ে এসে মহফুজ সাহেব এবং বিজয়কৃষ্ণবাবুকে বসতে দেবে। লোকজন এসে চারপাশে ভিড় করে দাঁড়াবে)
অল্প বয়সী ছেলেঃ সাইকেল চোর ধরা পড়েছে। সাইকেল চোর ধরা পড়েছে। (এই বলে ছুটতে ছুটতে এসে ভিড় ঠেলে উঁকি মারবে)
পথচারী একঃ ব্যাটা চোর। এখন গণধোলাই থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে।
পথচারী দুইঃ বাবা! যে সে চোর নয়, একেই বলে বুদ্ধিমান চোর।
মহফুজ আলমঃ এই চুপ! কেউ আর একটা কথা বলবে না। এই যে ছেলে তোমার নাম কী?
চোরঃ নরেন, নরেন প্রামাণিক।
মহফুজ আলমঃ নরেন! বাঃ সুন্দর নাম তো। ভারতবর্ষের একজন মহান মনীষীর নামও নরেন।
চোরঃ সে আমি জানি। তিনি হলেন বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ।
মহফুজ আলমঃ তোমার জ্ঞানের নাড়ী তো বাবা বেশ টনটনে।
চোরঃ কী যে বলেন! বি.এসসি, বি.এড পাস ছেলে। এইটুকু জানবো না?
বিজয়কৃষ্ণঃ তুমি বি.এসসি, বি.এড পাস করেছো! তোমার বাড়ি কোথায় বাপ?
চোরঃ বাড়ি আমার চৈতন্যপুরের চোরবাগানে।
বিজয়কৃষ্ণঃ তা বেশ। চোরবাগানের ছেলে যখন, তো বলতো বাবা – কেন তুমি চোর নও। শুনি তোমার ব্যাখ্যাটা। একটু গুছিয়ে বলো।
চোরঃ দেখুন, বলার সুযোগ যখন দিয়েছেন, তখন একটু গুছিয়েই বলি। আমাদের রাজ্যের মন্ত্রী, বিধায়ক, নেতারা হাজার হাজার চাকরি চুরি করে চড়া দামে বেচে টাকার পাহাড়, পর্বত বানিয়ে ফেলেছেন। তবু তাঁরা কোর্টে দাঁড়িয়ে বিচারককে বলছেন – হুজুর, আমরা চোর নই। সেই হিসেবে আমি কোন্ ছার? এক হতভাগ্য বেকার যুবক, বয়স্ক মা-বাবার মাথার বোঝা। নিরূপায় হয়ে আজই প্রথম সাইকেলটায় হাত বাড়িয়েছিলাম। নিতে আর পারলাম কই? তাও তো পুরানো, মরচে ধরা সাইকেল। তার উপর চোরাই মালে দু’শো টাকার বেশি জুটত না। ভদ্র মহোদয়গণ, ওই নেতা, বিধায়ক, মন্ত্রীরা কোটি কোটি টাকা চুরি করে যখন চোর নন, সেক্ষেত্রে কি আমাকে চোর বলা যায়?
মহফুজ আলমঃ বা! যুক্তি তোমার মন্দ নয়, কী বলো বিজয়কৃষ্ণ? ছেলে বড়ই বুদ্ধিমান।
বিজয়কৃষ্ণঃ মহফুজ সাহেব, আপনার সাথে আমি একমত। কিন্তু এই ছোকরারা কি আমাদের সাথে একমত হবে?
পথচারী একঃ (কানে ফোন তুলে কারো সাথে কথা বলছিল) না না, আমরা একমত নই।
পথচারী দুইঃ আমরা বিচার চাই। চোরের শাস্তি চাই।
যুবকঃ দেখুন, সকলের উদ্দেশ্যে বলছি, সাইকেলটা আমার। আমিও একজন বেকার যুবক। বেকারের যন্ত্রণা আমি বুঝি। তাই আমার পক্ষ থেকে আমি ওকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। ওর শাস্তি হোক – আমি চাই না।
ভিড়ের মধ্য থেকে অনেকেঃ না, একেবারেই না, আমরা কোনো কথা শুনবো না। আমরা চোরের শাস্তি চাই।
পথচারী একঃ (কানে ফোন তুলেই আছে) সবাই শোনো, এই মাত্র ফোনে আমার সাথে কথা হল। আমাদের প্রিয় বিধায়ক, একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, মন্ত্রী, বিশিষ্ট জননেতাও বটে, উনি এই এলাকাতে আছেন নিজের বাসভবনে। উনি আসছেন চোরের বিচার করতে। এই কে আছিস্, একখানা চেয়ার নিয়ে আয়।
পথচারী দুইঃ এই পল্টু, ঐ দ্যাখ্, কে একজন আসছেন। এই দিকেই আসছেন রে। দেখে তো মনে হচ্ছে – ভদ্রলোক গোছের, নিশ্চয় বড়সড় কোনো জ্ঞানী মানুষ।
(অচেনা ভদ্রলোকের প্রবেশ)
ভদ্রলোকঃ এখানে কী হয়েছে? কার বিচার হচ্ছে? এই তোমরা সরো, আমাকে একটু দেখতে দাও। (চোরের কাছাকাছি গিয়ে) একি নরেন, হতভাগা তুই? তুই সাইকেল চুরি করে পালাচ্ছিলি? তা আবার হতভাগা পরাণের সাইকেল?
যুবকঃ এই তো, আমিই সেই পরাণ। আপনি জানলেন কী করে? আপনাকে তো আমি চিনি না। কে আপনি?
চোরঃ মহাশয়, আমিও কোনদিন আপনাকে দেখিনি। আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?
ভদ্রলোকঃ তোরা কেউ আমাকে চিনিস্ না। অথচ আমি সকলকে চিনি। সকলের নাম জানি। থাক্ এসব কথা। নরেন, তুই তো ভালো ছেলে। এই অপকর্ম করতে গেলি কেন?
চোরঃ (কেঁদে ফেলে) লেখাপড়া শিখেও একটা ভালো কাজ পাইনি। সংসারে আমার বড় দুঃখ-কষ্ট।
ভদ্রলোকঃ চুপ কর্। সব জানি আমি। তোর মা,বাবা রোগশয্যায়। একটা চাকরির জন্য কত দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছিস্। মেধা তালিকায় তোর নাম উঠেছিল। যোগ্য প্রার্থী হয়েও চাকরিটা তোর হয়নি। হবে কী করে? চাকরিটা যে চুরি হয়ে গেছে। সংসারে দুঃখ-দুর্দশা। মা-বাবার চোখের জল। তুই সইতে পারিস্ নি। তাই বাধ্য হয়ে এই অপকর্মের পথে নেমে পড়েছিলি। তোর মতো পরাণেরও মেধা তালিকায় নাম উঠেছিল। আরও অনেকেরই উঠেছিল। সবারই চাকরি চুরি গেছে।
যুবকঃ আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এই গোপন কথা আপনি জানলেন কী করে? ভদ্রলোকঃ আ! আবার সেই একই কথা। বলেছি না – আমি সব জানি।
যুবকঃ তাহলে আপনাকে সত্যি কথাটা বলে দিই। (চোখের জল মুছে )সংসারে আমারও নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট। আমিও মনে মনে নরেনের মতোই ভেবেছিলাম – মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার আর যখন কোনও উপায় নেই, তখন চুরির পথই হোক বা যে কোনও অপকর্মই হোক, সেই অসৎ পথে নেমে পড়বো।
ভদ্রলোকঃ তাও আমি জানি। কাঁদিস না। শোন্, অমানুষ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই বরং শ্রেয়। যদি মরতেই হয়, রাজপথে দাঁড়িয়ে খিদের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মরে যাওয়া ভালো। সে মৃত্যুর কথা ইতিহাস চিরদিন মনে রাখবে। যাবার কালে আর একটা কথা বলে যাই – যিনি আসছেন বিচার করতে, নরেনকে শাস্তি দিতে, অসৎ পথে উপার্জিত অর্থে তাঁর অনেক বৈভব। একদিন তাঁর বিচার হবে মানুষের আদালতে। সত্য বড় কঠিন।
(দ্রুত ভিড় ঠেলে চলে যাবেন। নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যাবেন )
নরেনঃ মহাশয়, মহাশয় আপনি কোথায় গেলেন? চলে গেলেন? কে আপনি, জানতেও পারলাম না!
বিজয়কৃষ্ণঃ সত্যিই বড় অদ্ভুত লোক তো। এই দেখলাম, এই মিলিয়ে গেল। তবে কোন্ সত্যের কথা উনি বলে গেলেন? কে উনি?
মহফুজ আলমঃ সকলে মন দিয়ে শোনো। উনি আর কেউ নন, উনি আমাদের বিবেক।
নরেনঃ ঠিকই বলেছেন। উনি আমাদের বিবেক।
যুবকঃ বুঝেছি। উনি এসেছিলেন আমাদের চোখ খুলে দিতে।
(বিশিষ্ট জননেতার প্রবেশ। চেয়ারও এসে গেছে)
জননেতাঃ কোথায় চোর? কেমন চোর? ব্যাটাকে উচিত শিক্ষাই দেবো।
নরেনঃ সাহেব, যাকে খুঁজছেন, আমিই সেই সাইকেল চোর ‘নরেন’। তবে শিক্ষা আমি পেয়েছি । একটু আগেই যিনি এসেছিলেন, চলেও গেলেন, সেই বিবেকের কাছে। শপথ করে বলছি – জীবনে আর এই কাজ কখনও করবো না। তবে আপনার কাছে এখন আমি একটা কৈফিয়ৎ নিতে চাই।
জননেতাঃ কৈফিয়ৎ? কীসের কৈফিয়ৎ? নরেনঃ আমার হকের চাকরিটা চুরি গেছে। পারবেন ফিরিয়ে দিতে?
পরাণঃ সাহেব, নরেনের মতো আমিও যোগ্য প্রার্থী ছিলাম। আমারও হকের চাকরিটা চুরি গেছে। ফিরিয়ে দিন।
জননেতাঃ তোরা এসব কথা আমাকে বলছিস্ কেন?
বিজয়কৃষ্ণঃ কারণ, আমরা জেনেছি – চাকরি চোরের তালিকায় আপনার নাম আছে। আপনিই শিরোমণি। আপনিই তো সেই বিশিষ্ট জননেতা, মন্ত্রী রূপ কুমার সেন। আপনি যোগ্যদের চাকরি চুরি করে অযোগ্যদের কাছে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন।
মহফুজ আলমঃ চাকরি চুরির টাকায় আপনার অগাধ সম্পত্তি হয়েছে। আর এই ছেলেগুলোর জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার, নির্মম পরিণতি। আপনি অপরাধী। জনতার আদালতে আজ আপনার বিচার হবে।
(বিবেকের পুনরায় আগমন বিচারকের বেশে)
বিবেকঃ (হাতে ‘চোর’ লেখা কালো টুপি) আমি আবার আসতে বাধ্য হলাম। রূপ কুমার সেন, তোমার বিচার করতে। আর এই নাও তোমার কৃতকর্মের উপহার। (টুপিটা মাথায় পরিয়ে দেবেন) মানুষ তোমাকে বিশ্বাস করে একদিন ফুলের মালা গলায় পরিয়েছিল। এই তার প্রতিদান দিলে? টাকার পর্বতে শুয়ে সুখ-নিদ্রার প্রহর গুনেছো। কখনো কি শুনতে পেয়েছো – অবহেলিত, বঞ্চিতের বুকফাটা কান্না? যে নরক-যন্ত্রণার পথে তুমি তাদের ঠেলে দিয়েছো, আজ নিজেই অনুভব করো – সেই যন্ত্রণা কী নিদারুন! কী নির্মম!
(বিবেকের দ্রুত প্রস্থান। বিলীন হয়ে যাবেন)
মহফুজ আলমঃ বিচারের রায় শুনিয়ে আবারও মিলিয়ে গেল বিবেক।
বিজয়কৃষ্ণঃ কী রহস্যময় তাঁর বিচারের বাণী! জানি, তোমরা সকলেই বুঝতে পেরেছো।
(চারদিক ঘিরে থাকা জনতার কৌতুহল। অল্প বয়সি ছেলেটি ছড়া বলতে থাকবে মজার ছন্দে। সকলে তাতে তাল মেলাবে)
অল্প বয়সি ছেলেঃ বুঝেছি গো, বুঝেছি।
“এ ব্যাটা দেশের মাথা, জননেতা, বলতে ভারি লজ্জা। ত্যাগ নেই যার, ভোগ শুধু সার, সাজায় ফুল-শয্যা। লোভ-লালসার সাগর-পাড়ে, গড়ল সুখের বাসা, ও ভাই, গড়ল সুখের বাসা। এ ব্যাটা চুরির দায়ে, কর্মদোষে, পেল যে তাই কঠোর সাজা।।
এ ব্যাটার বুদ্ধি খাসা, সর্বনাশা, শুধুই যে তাঁর টাকার নেশা। চকচকে এক নকল সোনা, আছে ওর হৃদয়হীনের ভালবাসা। নিপীড়িতের গলা কেটে, কামিয়ে টাকা যেত সুখ-নিদ্রা, ও ভাই, যেত সুখ-নিদ্রা। এ ব্যাটা চুরির দায়ে, কর্মদোষে,পেল যে তাই কঠোর সাজা।।
এ ব্যাটার অট্টহাসি,সময় ফুরিয়েছে। ক্ষমাহীন অপরাধে যাবে নির্বাসনে, ও ভাই যাবে নির্বাসনে। জীবনে আর কোনো পথ নেই যে তাঁর খোলা। এ ব্যাটা চুরির দায়ে, কর্মদোষে, পেল যে তাই কঠোর সাজা।।”
( সকলে জননেতাকে কেন্দ্র করে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে হাতে তালি মেরে ছড়া গানটি করতে থাকবে। বাজবে ঢাক-ঢোল। অথবা জননেতাকে সামনে রেখে কিছুটা শোভাযাত্রা করা যেতে পারে)
……………………………………………………….