– Sukla Sarkar
অনেক দিন ধরে এক রকম গৃহ বন্দি থাকার পর
আজ আবার সুজয় সেই নির্ঝড় পাহাড়ের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল , এমন সময় তার পুরানো বন্ধু অলকেশের
সাথে দেখা হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস? আমাকে দেখে চিনতে পারছিস ? তোকে চিনবো
না? বল কেমন আছিস ? ভালো । ভাবছি এবার বাইরে কোথায় ঘুরতে যাব, যাবি ? হ্যাঁ চল, কিন্তু
কোথায় যাওয়া যায় বলতো? কেন? সবুজ দ্বীপ। চারিদিকে নীল সমুদ্র আর মাঝে অপূর্ব সুন্দর
স্বর্গ রাজ্য । সেই মত পরদিন দুজনে অনেক খাবার, জল, পোষাক ও ওষুধ পথ্য নিয়ে বেরিয়ে পড়ল
। সূর্য যখন মাথার ওপর তখন তারা একটি বনের কাছে এসে পৌঁছালো । ঠিক করল এখানে আজ রাত
কাটাবে । তাবু খাটিয়ে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল । অনেক রাত যখন হয়ে গেছে তখন বহু দূর থেকে
একটি গানের সুন্দর সুর ভেসে আসছিল । সুজয় তখন অলোকেশকে ডেকে বলল, শোন কে যেন গান করছে ।ঘুমতো, এখন অনেক রাত, ওসব কানে নিস না । এই বলে
অলোকেশ আবার ঘুমিয়ে পড়ল । কিন্তু সুজয় আর ঠিক থাকতে পারল না। সে
তাবুর বাইরে এসে লক্ষ্য করছিল, কোথা থেকে এমন মিষ্টি সুর ভেসে আসছে । মনে হচ্ছে – খুব কাছে । গান সে ছোটো
থেকে ভালোবাসে কিন্তু এ সুর যেন তার খুব পরিচিত বলে মনে হচ্ছে । সে কখন যেন ভাবতে ভাবতে
বনের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে তা নিজেও জানে না । অনেকক্ষণ পরে দেখতে পেল – একটি মোটা
গাছের গোড়ায় বসে এক সুন্দরী মেয়ে গান করছে । সে তাড়াতাড়ি তার কাছে যেতেই কোথায় যেন
মিলিয়ে গেল । সে ওই গাছের গুঁড়ির ওপর বসে ভাবতে লাগল – মেয়েটি কে ? চেনা চেনা লাগছে,
তবু চিনতে পারছি না । এমন সুন্দর গান সে কোথায় শিখেছে ? দেখা হলে জিজ্ঞেস করব – সে
কেআর কোথায় থাকে ? ভোর হয়ে গেল । সুজয় ফিরে
এল তাবুতে । ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে অলোকেশের । তাকে সুজয় যখন সব কথা বলল কৌতূহল জাগল
মনে – মেয়েটিকে সেও দেখতে চায় । বনের তাবুতেই থেকে গেল তারা । সুজয়ের কৌতূহল আরও বেশি
। মেয়েটি যেন তার অনেক চেনা, অনেক আপনজন । ঝাপসা হয়ে ভাসছে চোখের সামনে ,আবার হারিয়ে
যাচ্ছে । এভাবে রাত যেন নেমে এল । নিশুতির প্রহরে আবার সেই গান, সেই সুর । ‘ওরে শুনতে
পাচ্ছিস অলোকেশ?’ কই না তো । কিন্তু আমি তো শুনতে পাচ্ছি । কী অদ্ভুত মধুর সুর! চল
এগিয়ে যাই , ঐ দিকে । বনের গভীরে এগিয়ে চলল সুজয়,অলোকেশ ।
সুজয় দেখতে পেল মেয়েটিকে, সামনে একটা গাছের
আড়ালে । সেই একই জায়গা । অপূর্ব সুন্দরী মনে হল মেয়েটিকে । মুখখানা এখনও ঝাপসা, থেকে
থেকে পরিষ্কার হয়ে আবার ঝাপসা হয়ে আসে । অলোকেশ কিছুই শুনতে পায় না । বলে – ‘সুজয় ,চলতো,এসব
তোর পাগলামী । কিন্তু সুজয় এগিয়ে যায় মেয়েটির কাছে । চলে লুকোচুরি খেলা । এভাবে রাত
শেষ হতেই ফিরে আসে দুই বন্ধু । অলোকেশ আবার একই কথা বলল – ধুর, এসব তোর পাগলামী । না
অলোকেশ, পাগলামি নয় । তুই বুঝবি না আমার মনের কথা । কত কী যেন আমার মনের মধ্যে ভেসে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে
। মনে পড়ছে অনেক কথা , আবার হারিয়ে যাচ্ছে ।’
আজ বন থেকে আধ ক্রোশ দূরে নদীর ধারে
একটি ধ্বংস প্রাপ্ত জঙ্গলাবৃত বড় বাড়ির কাছে এসে তারা তাবু পাতল । এক বুড়ো জেলের মুখে
শুনল – ধ্বংসাবশেষটি একটি রাজবাড়ী ছিল । রাজার বংশধরেরা এখানে আর থাকে না । অলোকেশ
জিজ্ঞেস করল – কেন থাকে না ? বুড়ো জেলে তখন বলল – “শুনেছি, অতীতে ঐ রাজবাড়ীতে একটা ঘটনা ঘটেছিল । রাজার দেওয়ানজির একমাত্র
কন্যা নিখোঁজ হয়েছিল । তবে তার অপমৃত্যু হয়েছিল অনেকের ধারণা । ” যে বনে তারা তাবু
পেতেছিল সেদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ ঐ যে দেখছেন না গভীর বন , ঐ বনের মধ্যে তাঁর
অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় । ঐ বনটা রাজাদেরই ছিল । এখন পতিত হয়ে পড়ে আছে । কেউ ভয়ে ওখানে
যায় না । ”
বুড়োর মুখে এসব শুনে সুজয়ের মনে আরও কত স্মৃতি
জেগে উঠতে চাইছে । অলোকেশের কৌতূহল আরো বেড়ে গেল । রাত নামলেই সুজয় আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল । অলোকেশ জাগা-ঘুমে থেকে একপ্রহরে একা চলে এলো ওই বনের মধ্যে । মেয়েটির রহস্যটা জানতে সে যেন ভয়ডরহীন হয়ে পড়েছে । এখন সুজয়ের কথাগুলো সত্যি বলে মনে হচ্ছে । অলোকেশ এমন সময় অদ্ভুত এক চিৎকার
শুনে, মরনের আগে এই কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসে , মনে সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতেই লম্বা দুটো হাত এসে অলোকেশের গলা টিপে ধরল । প্রাণটা বেরিয়ে যাবার উপক্রম হল । অমনি পেছন থেকে বলে উঠল, ‘এখানে কেন এসেছিস ? আর কখনও আসবি না । চলে যা যদি বাঁচতে চাস,’ এই বলে ছেড়ে দিল আর হাত দুটো মিলিয়ে গেল ।
অলোকেশ প্রান হাতে করে প্রচন্ড ভয় পেয়ে ফিরে এল । সুজয়কে কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়ল, আর ভাবল, ‘সকাল হলেই চলে যাবো, সুজয় থাকে থাকুক । বুড়ো ঠিকই বলেছে -ঐ বনে অতৃপ্ত আত্মা আছে ।’
এরপর নিশুতির প্রহর । গানের সুরে সুজয়ের ঘুম
ভেঙে গেল । সে চলল বনের দিকে । ভেতরে ঢুকে সেই
একই দৃশ্য দেখতে পেল । মোটা গাছটার গোড়ায় বসে মেয়েটি গান করছে । বিষাদের সে গান, প্রিয়তমাকে হারানোর ব্যাথার গান । আজ সে সুন্দর পোশাক পড়ে এসেছে ,সেজেগুঁজে এসেছে । সুজয় অনেক কাছে চলে এসেছে, একেবারে কাছে । আজ মেয়েটি লুকোচুরি খেলল না । আজ আর ঝাপসা নয় , মেয়েটির পরিষ্কার মুখমন্ডল দেখা গেল । সুজয় অবাক চোখে তাকিয়ে রইল । মেয়েটিও পলকহীন চোখে চোখ রেখে
দাঁড়িয়ে পড়ল । সুজয়ের কেমন বোধ হতে লাগল , কোথায় যেন মেয়েটিকে সে দেখেছে, খুব চেনা লাগছে ,মাথাটা ঘুরতে শুরু করেছে, সেই অবস্থায় সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল তুমি আমাকে চেনো ? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর – আপনজনকে কেউ কি ভোলে? অবাক হয়ে সুজয় বললো, ‘তুমি থাকো কোথায় ? তোমার নাম কি ? মেয়েটি আঙ্গুল দিয়ে দূরে রাজবাড়িটার দিকে দেখালো , আর তার নাম বললো ‘মল্লিকা’ । সুজয়ের মনে হল – এই নামটা তার খুব চেনা লাগছে । কিন্তু কিছুই
মনে পড়ছে না । তারপর মেয়েটি বললো, চলো, আমার বাড়ি যাবে না ? ‘হ্যাঁ চলো’ এই বলে দুজনে পথ চলতে লাগলো । তবে
শর্ত দিল তুমি আমাকে স্পর্শ করবে না । তাহলে আমি হারিয়ে যাব । ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজবাড়ির কাছে এসে
পূর্বদিকে একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়ে বলল , ‘এইখানে আমি থাকি । দেবী আমার কাছে
মা, তাঁর কাছে প্রার্থনা করি – আমার প্রিয়তমকে কাছে পাবার জন্য ।’ সুজয় জিজ্ঞেস করল
– ‘কে তোমার প্রিয়তম ?’ ‘সে আমার অনেক কাছে ,কিন্তু চিনতে পারছে না।’ ‘আচ্ছা তুমি আমাকে
আপনজন বলছো কেন ?’
মেয়েটি হাসল, তারপর সুজয়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল – তুমি এই বিশাল অট্টালিকা চিনতে পারছ না? ‘অট্টালিকা ? এতো রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ ।’ ‘তুমি জন্মান্তরবাদ মানো না ? আত্মা কখনো মরে না । সেই আত্মা নতুন করে জন্ম নিলে সে
তার পূর্ব জীবনের স্মৃতি ভুলে যায় । তেমন করে তুমিও ভুলে গেছে সব ।’ ‘তবে কি পূর্ব জন্মে তুমি আমার কেউ ছিলে ? তুমি কি পূর্ব জন্মেই
আছো ?’ ‘ঠিকই বলেছো , আমি পূর্ব জীবনেই আছি তোমার পথ চেয়ে । বড় দুঃখে আছি । চেয়ে দ্যাখো যুগ যুগ ধরে আমার চোখের জল শুকায়নি ।’
সুজয়ের চোখে ভেসে ওঠে অস্পষ্ট স্মৃতি । প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয় মাথায় । চিৎকার করে ওঠে, উঃ আর পারছি না কোনো কিছু মনে করতে ।’ মেয়েটি তখন এক গ্লাস সরবত নিয়ে এসে টেবিলে রাখে, বলে, ‘নাও, খেয়ে নাও । সব যন্ত্রণা কমে যাবে । ফিরে আসবে তোমার সব স্মৃতি ।’
ঠিক তাই হল । সরবত পান করার পর সুজয় বেশ সুস্থ হয়ে উঠলো । চোখের সামনে অতীতের সেই রাজবাড়ী দেখতে পেল । রাজবাড়ির সামনে গোছানো অপূর্ব সুন্দর
সুন্দর সুগন্ধি ফুলের বাগান । চির বসন্ত বিরাজমান । চারদিকে কত রঙের বাহার, কত না পাখির গানের সুর, কত রকমের ফলের বাগান । এ যেন বিধাতার দান । তারপর ভিতরে প্রবেশ করল সুজয় । রাজ সিংহাসনে গিয়ে বসল । অমনি তাঁর মনে পড়তে লাগলো – পূর্ব জীবনে সে ছিল সদ্য অভিষেক হওয়া তরুণ রাজা ‘বিক্রম’ । বিক্রম এবার উল্লাসিত হয়ে ‘মল্লিকা, মল্লিকা’ বলে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায় । না বিক্রম , আর কাছে এসো না, আমি যে অদৃশ্য হয়ে যাবো । ‘তবে কি আমি তোমাকে কোনদিনই কাছে পাবো না ? সময় হোক , নিশ্চয়ই তোমার–আমার মিলন হবে । আমাদের ভালোবাসা চির অমর হয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা
থাকবে । ‘মল্লিকা , হঠাৎ করে তুমি কি করে হারিয়ে গিয়েছিলে? তুমি নিখোঁজ হয়েছিলে ? আমি তোমাকে কত খুজেছি ! কত দেশে দেশে গিয়েছি, দেখা পাইনি ।’ হ্যাঁ কুমার । শুধু অপরাধ ছিল – তুমি ছিলে রাজার ছেলে , আর আমি ছিলাম রাজার কর্মচারী ‘দেওয়ানজী’র মেয়ে । তুমি–আমি দুজনেই গান শিখতাম এক ওস্তাদদের কাছে । গান গাইতাম নির্জনে বসে একসাথে । আমাদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । মেনে নিতে পারেনি তোমার বাবা । একদিন আমাকে গোপনে বিশ্বস্ত রক্ষীরা হাত-মুখ বেঁধে ধরে নিয়ে
গেল ওই গভীর বনের মধ্যে । ওই বড় গাছটার তলায় গর্ত খুঁড়ে আমাকে জ্যান্ত পুঁতে দিল । আমার অতৃপ্ত আত্মা বেরিয়ে এলো দেহ থেকে । আমার আর পূর্নজন্ম হলো না । ওই গাছের তলাতেই আশ্রয় হল । আমার আকুতি–মিনতি, করুন আর্তনাদে বিগলিত হয়ে যমরাজ এসে আশীর্বাদ করে চলে গেল এই বলে যে, ‘যদি কোনদিন তোমার প্রিয়জন এই বনের মধ্যে তোমার সামনে এসে দাঁড়ায় সেদিন তোমার মুক্তির দুয়ার খুলে যাবে । দুজনের মহামিলনের স্বপ্ন পূরণ হবে ।’ তাইতো আমি অপেক্ষায় পথ চেয়ে
বসেছিলাম যুগ যুগ ধরে । শুধু বিষাদের গান গেয়ে সময় কাটিয়েছি । ‘তাহলে বলো, এবার আমাদের মুক্তি, মহামিলন ঘটবে কি করে ?’
মল্লিকা বললো, ‘একটু দাঁড়াও, সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।’ এই বলে মল্লিকা মন্দির থেকে একটি ফুল এনে স্পর্শ না
করে সুজয়ের হাতে দিল । ফুলটি সাদা পাপড়িতে ভরা, অপূর্ব সুন্দর, ভারি মিষ্টি তার সুবাস । ফুলটি থেকে জ্যোতি বেরিয়ে সুজয়কে ঘিরে এক স্বেতশুভ্র বলয়ের সৃষ্টি হল । তার মধ্যে চিরঘুমে ঘুমিয়ে
পড়ল সুজয়, তাঁর নশ্বর দেহ ছেড়ে বেরিয়ে এল অবিনশ্বর আত্মা । সে দুহাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল তাঁর প্রিয়তমা মল্লিকাকে । ‘মল্লিকা, এই তো আমি তোমাকে কাছে পেয়েছি, কত কাছে! আর কোনদিন আমি তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাব না, তুমিও হারাবে না ।’ ‘হ্যাঁ সুজয়, আমরা দুজনে আবার নতুন করে জন্ম
নেব, রাজার ঘরে নয়, সাধারণ ঘরে, এক ছোট্ট নদীর এপার আর ওপারে । চিনতে ভূল হবে না । তুমি লিখবে মানুষের কবিতা, আমি গাইবো জীবনের জয়গান । অভিজাত্য আমাদের মিলন চায়নি, সুখী হতে দেয়নি । তাই এবার দুঃখের পারাপারে দুই স্রোতস্বিনীর মিলন হবে, মোহনায় রচিত হবে ফুলশয্যা ।