(জীবনদর্শন) |
‘জীবনদর্শন’ গল্প নয়, কবিতা নয়, সাহিত্যের এক নতুন সোপান। জীবনের স্বরূপ নিরূপণ। |
সমালোচন | – হরবিলাস সরকার |
কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বোচ্চ নেতা তথা দলের সাধারণ সম্পাদক ‘কমরেড অগ্নীশ্বর শর্মা’ জেলা সম্পাদক মণ্ডলীকে নিয়ে বৈঠকে বসেছেন। হঠাৎ একজন সাধারণ কর্মী সাদামাটা পোশাকে, উসকোখুসকো চুলে, ছেঁড়া চটি পায়ে বিনা আমন্ত্রণে সেখানে উপস্থিত হয়ে সর্বোচ্চ নেতাকে অনুরোধ করলেন, কমরেড, মার্জনা করবেন। যদি অনুমতি দেন আমি এই সভায় কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই।
অনুমতি দিলাম।
ওই কর্মী প্রথমে জেলা সম্পাদককে প্রশ্ন করলেন, কমরেড প্রবনদেব, আপনি বাইশ লক্ষ টাকার গাড়িতে কেন চড়েন? না, আসলে বলতে চেয়েছি – আপনার এত দামি গাড়ি কেন?
পবনদেব চকিত চিত্তে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলেন, কমরেড, গাড়িটা শ্রমিকেরা তৈরি করেছে। তারা আধপেট খেয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রক্ত জল করে এই কাজ করেছে। দুনিয়ার যত মহান সৃষ্টি শ্রমিকেরাই করে। দুর্ভাগ্য, তারাই ভোগ করতে পারে না। অথচ সুখকর জীবন তাদেরই ভোগ করার কথা। আমিও শ্রমিক, শ্রমিক শ্রেণির একজন প্রতিনিধি। তাই আমি যদি একটু সুখ ভোগ করে থাকি, তাতে অন্যায় কোথায়?
গোটা হলঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মুহূর্তের মৌনতা বুঝিয়ে দিল, “যুক্তি সঠিক”। তবে সকলের চোখ কমরেড অগ্নীশ্বরের দিকে। কী প্রতিক্রিয়া হয়, তার অপেক্ষায়।
কিন্তু কর্মীটি প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় না থেকে জেলা সম্পাদককে আবার প্রশ্ন করে বসল, এ আপনার কেমন চিন্তাধারা পবনদেব? সঙ্গে সঙ্গে সবার উদ্দেশ্যেও প্রশ্ন রাখল, আপনারা প্রত্যেকেই কি এমন চিন্তাধারা পোষণ করেন?
সভাস্থলে চাপা স্বরে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। কী এমন ভুল কথা? সর্বহারার মহান নেতা তো বলেছেন, মেহনতি মানুষেরাই দুনিয়াকে রূপ-রস-সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলেছেন। মানব সভ্যতার যা কিছু অবদান, সবই মেহনতি মানুষেরই। তাহলে সেসবের প্রতি অধিকার কাদের?
কর্মী এবার কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, ভুল আপনাদের চিন্তাধারা। সর্বহারার মহান নেতা ‘মার্কসে’র বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করেছেন। আপনাদের জীবনে ত্যাগের আদর্শ কোথায়? ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে নিজেকে শ্রমিক বলে ভাবছেন? কমরেডস, আপনারা তো নিজেদের দুর্ভাগা মেহনতি মানুষের কাছের মানুষ বলে ভাবেন। তাদের সুখ-দুঃখের সাথী। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন কোথায়? ক’জন আপনাদের কাছের মানুষ বলে ভাবে, বলুন তো? এরপর সর্বোচ্চ নেতার উদ্দেশ্যেও বলল, প্রিয় কমরেড, এবার আপনাকেও আমার কিছু কথা বলার আছে। মন দিয়ে শুনুন। আমি যতদূর জানি, আপনি সাধারণ ঘর থেকে অত্যন্ত কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে উঠে আসা মানুষের মুক্তিযুদ্ধের এক বলিষ্ঠ সৈনিক। কিন্তু আপনার মহান আদর্শ নিম্নতর নেতৃত্বের স্তরে উপেক্ষিত। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই আপনি অবগত। তৎসত্ত্বেও আপনি সংশোধনের বিন্দুমাত্র প্রয়াস করেছেন কিনা, আমার জানা নেই। তবে হলফ করে বলতে পারি, জীবনসংগ্রামে তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন ঘটেনি। তাইতো নির্বাচনে এই ভরাডুবি।
অগ্নীশ্বর অবাক-চোখে কর্মীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কমরেড নটরাজ, জেলা সহসম্পাদক, কর্মীকে বেশ কড়া মেজাজে বললেন, কমরেড, তোমার এই ঔদ্ধত্য ক্ষমাহীন। নেতৃত্ব সম্পর্কে তোমার ধারণা ভুল। নির্বাচন সম্পর্কেও ধারণা ভুল। আচ্ছা উত্তর দাও তো, ক্ষমতাসীন শাসকদলের সিংহভাগ প্রতিনিধিই তো কোটিপতি, ভোগ-বিলাসিতাই যাদের জীবনের উদ্দেশ্য। তারা তাহলে কীভাবে নিঃস্ব-নিপীড়িতের কাছের মানুষ হয়ে গেল?
কমরেড অনুরাধা শান্ত মেজাজে কর্মীকে বোঝালেন, শোন কমরেড, ভাই আমার, নির্বাচনে শাসকের জয়ের রহস্যটা তুমি বুঝতে পারোনি। ওরা নানা প্রলোভনের জাল বিছিয়েছে। জাত-পাত নিয়ে বিভাজনের খেলা খেলেছে। আবার সংখ্যালঘুদের ত্রাতা সেজে তাদের দুয়ারে হাজির হয়েছে। এসবের পরও ত্রাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করে মানুষকে জোয়ালে বেঁধে ভোট আদায় করেছে।
অগ্নীশ্বরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ধমক দিলেন, থামুন আপনারা। এসব যুক্তি হাস্যকর এবং মূল্যহীন। তবে এর বিশ্লেষণ আমি করবো না। চলুন সকলে, আমাদের এই একনিষ্ঠ কর্মীর প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানকার মানুষেরাই যা বলার বলবে।
অনিচ্ছাকৃত হলেও সকলে যেতে বাধ্য হলেন।
ভরা গ্রীষ্মের বিকেল। চার গ্রামের কেন্দ্রস্থলে একটি বটবৃক্ষ দীর্ঘকালের সাক্ষীরূপে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁরই ছায়াতলে একটি বাঁশের মাচা। তার উপর বসে আছে বৃদ্ধ, যুবক, বয়স্ক মা মিলিয়ে জনা দশেক মানুষ।
নেতৃবৃন্দের সমাগম দেখে আশেপাশের আরও মানুষজন এসে জড়ো হতে লাগলো। এক যুবক অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, কমরেড, আপনারা? এক বৃদ্ধ কমরেড অগ্নীশ্বরকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, চৌত্রিশ বছর ক্ষমতায় থাইকা আজ আপনারা শুন্য। মনে কিছু করবেন না কমরেড, একদিন আমিও মিছিল-মিটিং করিছি, আন্দোলন করিছি। সমাজের কোন পরিবর্তন হয়নিকো। গরিব আরও গরীব হইয়া গেল। ধনী আরও ধনী হইয়া উঠল। জোর-জুলুম কইরা কেউ পরের সম্পত্তি হাতাইয়া নিলো। কেউ সব হারাইয়া ভিখিরি হইয়া গেল। কমিউনিস্ট পার্টির নাম হইয়া গেল ‘কামিয়ে নিস পার্টি’। লোকজন সইরা গেল। আমিও এই সব দেইখা মুখ ফিরাইয়া নিলাম। শেষে এমন অবস্থা হইল যে, লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি দেখাইয়াও মানুষেরে ধইরা রাখতে পারলেন না। রাজ্যে আইল নতুন সরকার।
অগ্নীশ্বর বললেন, হ্যাঁ, আমাদের মন্দ অনেক কিছুই ছিল। সেগুলো আমরা আজও শুধরে উঠতে পারিনি। যাইহোক, নতুন সরকারেরও এক যুগ পার হয়ে গেল। এবার আপনারা ওদের কথাও বলুন। সমাজের ওরা কী পরিবর্তন করেছে? ভালো কিছু করেছে?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র, এখন বছর বিয়াল্লিশের বেকার যুবক উত্তরটা দিল, না, পরিবর্তন কিছুই করেনি। বরং আপনারা যেখানে শেষ করেছেন, ওরা সেখান থেকে শুরু করেছে। আর চরম সীমায় পৌঁছে গেছে।
তাই যদি হবে, বিপুল মানুষ ওদের সমর্থন করছে কেন?
তারও কারণ আছে কমরেড। মানুষ ওদের সাথে আপনাদেরকে মেলায়। একদিন আপনাদের নেতা-কর্মীরা বেছে বেছে বাড়ির উঠোনে সাদা থান পৌঁছে দিত, কারও কারও দরজায় জন্মনিরোধক বস্তু ফেলে আসত, রাতের অন্ধকারে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত, মানুষের তাজা রক্ত দেখে উল্লাস করত, তারা তো আজও দলের সম্পদ। তাদের চোখের সামনে দেখে আজও মানুষ শিউরে ওঠে। যে নেতারা একদিন ঝনঝনে সাইকেলে ঘুরে বেড়াতো, বেড়ার ঘরে দিন যাপন করতো, পরবর্তীকালে তাদের দামি দামি গাড়ি, তিনতলা-চারতলা বাড়ি হয়ে গেল। তারা কী করে মেহনতি মানুষের বন্ধু থাকে, বলুন? মুশকিল কী জানেন, আমরা হতভাগারা পরিবর্তন চেয়েও পরিবর্তন আনতে পারিনি। তবুও মন্দের ভালোকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরি।
বছর পঞ্চাশের এক মা বলে ওঠেন, ছেলে আমাদের ঠিকই বলিছে কমরেড। ভালো তো কাউরে খুঁজে পাইনা। শান্তির পরিবেশ কে ফিরাইয়া আনবি? মেয়েদের সম্মান খোয়া যাচ্ছে। ছেলেরা বিপথে চইলা যাচ্ছে। কাউরে আর ভরসা পাই না। এখন তো আবার ‘রাম-নামে’ দেশ উত্তাল হইছে। ওতে কি আর পেট ভরবি? শুধু মানুষ ভাগাভাগি হবে, হানাহানি কইরা মরবে। গরিব মানুষ আমরা। আমাদের বাঁইচা থাকাটাই দায়। তবু তো লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পাই, কন্যাশ্রী পাই, স্বাস্থ্য সাথী, সবুজ সাথী, আরও তো কত কিছু। কে চুরি করলো, কে জেল খাটলো, ওসব ভেবে আমাদের কী লাভ?
অগ্নীশ্বর কর্মীর পীঠ চাপড়ে দিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে সকল কমরেডদের নিয়ে ফিরে এলেন। ক্ষণিক বিশ্রামান্তে আবার বৈঠক। তবে এই বৈঠকে কমরেড অগ্নীশ্বর একমাত্র বক্তা। বাকি সকলে শ্রোতা। তিনি বললেন, কমরেডস, ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে মহান ‘কার্ল মার্কস‘ মানুষের মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। দারিদ্র্যের নির্মম যাতনা তাঁকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। তাঁর সমসাময়িক সহযোগী ‘এঙ্গেলস’ প্রভূত ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েও মার্কসের চিন্তাকে বাস্তবে প্রতিফলিত করবার জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে গেছেন। আমরা প্রত্যেকেই সেই মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক। আজকের কঠিন সময়ে কঠিন দায়িত্ব পালনের ভার আমাদেরই। কিন্তু দুনিয়াকে বদলাতে গেলে নিজেদেরকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। উদ্যানে জঙ্গল শোভা পায় না। পুষ্পশোভিত বাগিচা আর ফুলের সুবাস মানুষের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে। মনে রাখবেন, বরেণ্য মনীষী বলে গেছেন, “পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না। পরের জন্য তোমার হৃদয়-কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও”। সমাজকে বদলাতে গেলে, আসুন আমরা শপথ নিই, “আমাদের জীবন হোক ফুলের মতো”। তাহলে সুদিন একদিন অবশ্যই আসবে। সেদিন আকাশে-বাতাসে মহাসমারোহে ধ্বনিত হবে, “দুনিয়ার মেহনতি মানুষ এক হও”।
………………………………………………………