গল্প |
বাংলা আমার মা | – হরবিলাস সরকার |
‘বাংলা’র শিক্ষক ‘পরিমলবাবু’ অষ্টম শ্রেণিতে এসে প্রিয় ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, বলতো, পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা কোনটি?
পনেরো ক্রমিক নাম্বারের ছেলে ‘সায়ন’ অন্যান্য বিষয়ে ভালো নয়, কিন্তু বাংলায় সে বরাবরই ভালো। গত বার্ষিক পরীক্ষায় ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’ রচনা লিখে দশে সাড়ে নয় পেয়েছে। সুমিষ্ট কন্ঠস্বর। গানও ভালো গায়। এরপর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ ও আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। সে আজ উঠে দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় উত্তর দিল, বাংলা ভাষা, স্যার।
পরিমলবাবু খুশি হয়ে বললেন, আজ আমি তোমাদের বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু কথা বলব।
নীরবতায় ভরে উঠল শ্রেণিকক্ষ। ছেলেদের এত কৌতূহল, আগ্রহ, জানবার আকাঙ্ক্ষা দেখে স্যার আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন। বললেন, আমি বড় হয়ে এসব কথা জেনেছি। ১৯৭১ সালে আমার বয়স তখন চার বছর। ফাল্গুনের শেষ কি চৈত্রের শুরু। পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারিরা বন্দুক তাক করে এগিয়ে আসছে। উদ্বাস্তু জনতার স্রোত প্রাণভয়ে তীব্র গতিতে বয়ে চলেছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিল অঞ্চলের দিকে। আমার বড়দিদি আমাকে কোলে নিয়ে ছুটল পাট ক্ষেতের ভেতর দিয়ে। পেছনে মেজদিদি। কিছুটা পেছনে ছিল বাবা, তার পেছনে মা। হঠাৎ একটা গুলির শব্দ, নিমেষে একটিবার ‘মা’ বলে চিৎকার। দিদিরা আরও জোরে ছুটতে লাগল। মা পেছন ঘুরে দেখল – পাশের বাড়ির এক কাকা সবুজ ঘাসের আলের উপর লুটিয়ে পড়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। আর দেখল, পেছনে অদূরে দু’জন গোঁফ-দাড়িওয়ালা ভয়ঙ্কর চেহারার পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি। ভাগ্যের বড়ই উপহার, মাকে ওরা গুলি করেনি। আমরা বিলের মধ্যে একটা উঁচু ভিটেয় গিয়ে আশ্রয় নিলাম।
ছাত্ররা শিউরে উঠল। জানতে চাইল, স্যার, বিলের মধ্যে আশ্রয় নিলেন কেন?
কেননা, পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারিরা বিলের মধ্যে ঢুকবে না। ওরা সাঁতার জানতো না। জল দেখলে ভয় পেত। এটা বড়রা জানতো। যাইহোক, এরপর ৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে নতুন রাষ্ট্র হল বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের নেতৃত্বে। তবে আমরা দেশান্তরী হয়ে চলে এলাম ভারতবর্ষে তথা এই পশ্চিমবাংলায়।
স্যার, স্বাধীনতার আগে কি ওই দেশের বাংলা ভাষা ছিল না?
ভালো প্রশ্ন করেছো। হ্যাঁ, পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা আগেও বাংলা ভাষায় কথা বলতো। কেননা, পূর্ব পাকিস্তান তো ছিল অবিভক্ত বাংলারই অংশ, পূর্ব বাংলা। পদ্মাপার পূর্ব বাংলা, গঙ্গাপার পশ্চিম বাংলা। এপার আর ওপার। ১৯৪৭ সালে পরাধীনতার গ্লানি থেকে ভারত মুক্তি পেল ঠিকই, কিন্তু শাসক ইংরেজ ভারতবর্ষকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে গেল। একটি খন্ড ভারতবর্ষ, অন্যটি পূর্ব বাংলাকে যুক্ত করে পাকিস্তান। অর্থাৎ পাকিস্তানের দু’টো অংশ। একটি পশ্চিম পাকিস্তান, অন্যটি পূর্ব পাকিস্তান।
সায়ন প্রশ্ন করল, স্যার, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধের কারণ কী ছিল?
বাঃ তুমি চমৎকার প্রশ্ন করেছো। তাহলে আমি তোমাদের একটা পাল্টা প্রশ্ন করছি। ইতিহাসে তোমরা কখনও শুনেছো, একটা পরাধীন ভূখণ্ড ভাষাকে কেন্দ্র করে স্বাধীন হয়েছে? একটিমাত্রই দেশ, পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশ। তাহলে শোন, পাকিস্তানি শাসক বাংলা মায়ের মুখের ভাষাকে কেড়ে নিয়ে উর্দু ভাষা চালু করতে চেয়েছিল। ওপার বাংলার মানুষ গর্জে উঠেছিল। বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে শুরু হল রক্ত-স্নাত লড়াই। সে লড়াই পরিনতি পেল মুক্তিযুদ্ধে। পৃথিবীর মাটিতে জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলা আমাদের মা, মায়ের প্রাণের ভাষা বাংলা, বড়ই শ্রুতিমধুর। কবিরা এই বাংলাকে নিয়ে কত কবিতা, গান লিখেছেন।
সেলিম দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি কবিতার প্রথম স্তবক আবৃত্তি করল। বলরাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাদেশ কবিতার কয়েকটি চরণ আবৃত্তি করল। এরপর সায়ন ধরল গান, ‘এই বাংলার মাটিতে মাগো, জন্ম আমায় দিও।’
সায়নের গানের পর ছুটির ঘন্টা বেজে উঠল। পরিমলবাবু বললেন, ছেলেরা, একটা ভীষণ দুঃখের খবর আছে। যে স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের এত গরিমা ছিল, সেখানে এখন হিংসার আগুন জ্বলছে। হিন্দু-মুসলমানেরা কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে দেশ মায়ের ভাষা ‘বাংলা’কে রক্ষা করেছিল। সেই স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সব ওরা ভুলে গেছে। আরও অনেক কথা বলার ছিল। আগামীকাল রবিবার সন্ধ্যায় তোমরা সকলে আমার বাড়িতে এসো। আমি তোমাদের সব বলব।
ছেলেরা মাথা ঝুঁকে সম্মতি জানালো। স্যার আজকের মতো বিদায় নিলেন।
ছেলেরা যে যার মতো বাড়ি ফিরল। কিন্তু সায়ন ফিরে দেখল তার বাড়ির ভেতরে বিষাদের ছোঁয়া। মায়ের চোখে জল। জানতে চাইল, কী হয়েছে মা?
ছোটখোকা রে, তোর বড়মামা হাসপাতালে ভর্তি। কেন? ক’দিন আগে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিল। জানিস তো, তোর বড়মামার শ্বশুরবাড়ি ওদেশে। হঠাৎ মৌলবাদীরা দেশটা দখল করে নিল। হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে, ও যে বুঝতে পারেনি।
মামার কী হয়েছে, একটু বুঝিয়ে বলতো।
দিদি ‘অরুন্ধুতী’ এসে বলল, মায়ের মনের অবস্থা ভালো নয় ভাই, বিরক্ত করিস না। আমি তোকে সবটা বলছি। বাংলাদেশে জিহাদি মৌলবাদীরা অবৈধভাবে শাসন ক্ষমতা দখল করেছে। ওরা শরিয়ত আইন চালু করতে চায়। দেশটাকে ইসলামিক রাষ্ট্র তৈরি করবে। সেকারণে সংখ্যালঘু হিন্দুদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে। সম্পত্তি দখল করে নিচ্ছে। মেয়েদের উপর নির্যাতন করছে। চলছে নির্বিচারে হত্যা। আর ভারতের মানুষ দেখলে, বিশেষ করে এদেশের বাংলাভাষী কাউকে দেখলে মারধর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
জানিস দিদি, আজ আমাদের বাংলার স্যার পরিমলবাবু বাংলা ভাষা নিয়ে বলতে গিয়ে এইসব দুঃখজনক ঘটনারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখন বুঝতে পারছি, দুই পারের হিন্দুদের নিয়ে উনি কতটা চিন্তিত! হ্যাঁরে দিদি, মা আর বাবা কি মামাকে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছে? হ্যাঁ। তুই যাবি না? নিশ্চয়ই যাবো। মামা যে আমাদের কত প্রিয় !
চার চাকার গাড়িটা ছুটলো মুর্শিদাবাদ জেলা হাসপাতালের দিকে।
পরিমলবাবু স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে টিভিটা খুলে বসেছিলেন। সেই থেকে দেখছেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু-নিধন-যজ্ঞ। এমনসময় ছুটতে ছুটতে এলেন দুই প্রতিবেশী, নিশীথ আর শোভন। তিনজনই বরিশালের লোক। দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক। বন্ধুও বটে। নিশীথ বড়ই দুশ্চিন্তা নিয়ে বলল, পরিমলদা, কী হবে? এবার চট্টগ্রামের ইসকন মন্দিরের প্রধান ‘চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভু’কে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশ-পুলিশ, রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা অভিযোগে। রংপুরে হিন্দু মেয়েদের উপর চলছে পাশবিক অত্যাচার।
শোভন গলাটা চড়িয়ে বলল, বাংলাদেশে এ তো সাংঘাতিক অরাজকতা চলছে, পরিমলদা। মৌলবাদীরা প্রকাশ্য রাস্তায় মিছিল করে বলছে, ‘ভারত যাদের মামার বাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি।’ আরেক দল গোপালগঞ্জে ফতোয়া জারি করে বলেছে, ‘আজ থেকে মেয়েরা পরিবারের পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাজারে যাবে না। দোকানদারদের উদ্দেশ্যে বলছি, কোন মেয়ে একা জিনিস কিনতে এলে, আপনারা তাকে জিনিস বেচবেন না। এটা শরিয়তের আইন। এই আইন অমান্য করলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে।’ এ যে তালিবানি শাসন, পরিমলদা। দেশটা দ্বিতীয় আফগানিস্তান হতে চলেছে।
পাশের গ্রাম থেকে এইমাত্র ফিরোজ খান এসে ঢুকলেন। পরিমলবাবুর সহকর্মী, ইতিহাসের শিক্ষক। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। আরবি, উর্দু ভাষায় পারদর্শী। নিশীথ ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলছিল। সেই রাগ গিয়ে পড়ল ফিরোজের উপর। ফিরোজ ভাই, তোমাদের লোকেরা এসব কী করছে? আমাদের আত্মীয়স্বজন আছে ওদেশে। শরিয়তের শিকলে সবাইকে বাঁধবে? এ তো নিষ্ঠুর বর্বরতা। এ কেমন ধর্ম ? ইতিহাসের অন্ধকার যুগকেও হার মানাবে।
শোভনও একই সুরে বলল, মুসলিম সমাজ নারীকে অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী করে রাখতে চায়। নারী ওদের কাছে ভোগ্যবস্তু, গুদামজাত মাল।
এইমাত্র টিভিতে ব্রেকিং নিউজ। জেল হেফাজতে চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর উপর চলছে অমানুষিক অত্যাচার। ফরিদপুরে জিহাদিদের লালসার শিকার পাঁচ যুবতী ও দুই গৃহবধূ।
ফিরোজ সাহেব নিশীথ ও শোভনের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। টিভির পর্দা থেকেও চোখ নামিয়ে নিলেন। বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার একটা আবেগ বরাবরই ছিল। সেই দেশে আজ নারকীয় ঘটনা চলছে, তা যেন নিজেও সহ্য করতে পারছেন না।
এমনসময় রঞ্জনা বৌদি এল চা নিয়ে। সকলকে চা দিয়ে বলল, তোমরা আজকের খবরের কাগজটা পড়েছো? জঘন্য ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশকে ওদশের মুসলমানরা আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়। শুধু তাই নয়, দু’কোটি জিহাদি জঙ্গি পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা আর ঝাড়খণ্ডে ঢুকে পড়েছে। এই রাজ্যগুলো দখল করে ওরা বৃহত্তর পাকিস্তান গঠন করবে।
পরিমলবাবু খবরের কাগজটা নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলেন। ফিরোজ সাহেব বললেন, বৌদিমনি, একথা যদি সত্যি হয়, তবে তা হবে ইসলামের পরিপন্থী। ইসলাম মানে শান্তি। শান্তির রাজ্যে অশান্তি আল্লা অনুমোদন করেন না। ইসলাম ‘পরদেশ, পররাজ্য দখল’ সমর্থন করে না।
শোভন ভ্রু কুচকে উত্তেজিত হয়ে বলল, রাখো ভাই তোমাদের ইসলামের কথা। তোমরা কি তোমাদের পূর্বপুরুষ মহম্মদ বিন কাসিম, মাহমুদ গজনভি, মহম্মদ ঘুরী, কুতুবউদ্দিন আইবক, আলাউদ্দিন খলজি,বাবরের কথা ভুলে গেলে? আরও অনেক উদাহরণ আছে ভাই।
পরিমলবাবু এবার মুখ খুললেন, ওসব ছাড়ো শোভন। আমি ভাবছি অন্য কথা। রঞ্জনার কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে তো ইতিহাসের পাতা থেকে বাঙালি জাতিটাই মুছে যাবে। বাঙালি না থাকলে বাংলা ভাষাটাই হারিয়ে যাবে। আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে উর্দু ভাষা।
ফিরোজ সাহেব যেন একঘরে হয়ে গেলেন। রঞ্জনাদি মৃদু হেসে চোখা প্রশ্ন করল, কি ফিরোজ সাহেব, ওপর ওপর মুখভার দেখালেও মনে মনে তো খুশি হয়েছেন। ভাবছেন, বাংলা পাকিস্তান হয়ে গেলে বাঙালি জাতিসত্তা লুপ্ত হবে। তখন হিন্দু পরিচয়টাও লুপ্ত হয়ে যাবে, তাই না?
বৌদি, আমাকে আঘাত করে লাভ কি? আমি মা-মাটি-মানুষের সরকারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। গান্ধীবাদে বিশ্বাসী, একজন গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ। শোভনবাবু দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসী। নিশীথবাবু, আপনারা বামপন্থী মানুষ। মার্কসবাদ আপনাদের আদর্শ। আমরা ভিন্ন আদর্শের মানুষ হলেও সম্প্রীতির প্রশ্নে আমাদের মধ্যে কোন বিবাদ নেই। বাংলাদেশে যা ঘটছে, অতীব নিন্দনীয়। তা নিয়ে আমাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে কোন লাভ আছে কি?
নিশীথ ভীষণভাবে প্রতিবাদ করল, ফিরোজ সাহেব, বিরোধ আপনারাই তৈরি করছেন। মুসলমান মৌলবাদীরা তৈরি করছে। আপনাদের এক মন্ত্রী বলেছেন, যে ইসলাম হয়ে জন্মায়নি, সে বড়ই দুর্ভাগা। এই বক্তব্য গণতন্ত্রের পক্ষে মহা বিপদ। শুধু বিপদ বললেও ভুল হবে। মহা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ওই পদ্মাপারের দিকে চেয়ে দেখুন। ওখানে হিন্দু-নিধন-যজ্ঞ চলছে। মুসলমান মৌলবাদীরা উল্লাস করছে। আপনারা চুপিসারে সেই উল্লাস অন্তরে উপভোগ করছেন, ক্ষমতার নির্লজ্জ উদগ্র বাসনায়।
ফিরোজ সাহেব কিছুটা চটে গেলেন। আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করলেন, মার্কসবাদীদের মুখে এতবার ‘হিন্দু’, ‘হিন্দু’ শব্দটা বৈষম্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করছে না কি?
পরিমলবাবু ভেবেছিলেন নীরব থাকবেন কিন্তু আর পারলেন না। ফিরোজের চোখে চোখ রেখে বললেন, দেখ, হিন্দু বলাটা অপরাধ নয়। একটা অর্থে তুমিও হিন্দু। অখন্ড ভারতবর্ষের মাটি মানে হিন্দুস্তানের মাটি। এই মাটিতে যারা জন্মেছে, সকলেই হিন্দু। তুমি মুসলিম পরিবারে জন্মালেও তোমার পূর্বপুরুষ হিন্দু ছিল। ৭১২ খ্রিস্টাব্দের আগে ভারতবর্ষে মুসলমান বলে কেউ ছিল না। কোন একটা সময়ে তোমার কোন এক পূর্বপুরুষ থেকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে তোমরা মুসলমান। এই সত্য অস্বীকার করবে কী করে ?
ফিরোজ এই যুক্তির মান্যতা দিয়ে বলল, ইতিহাসের ছাত্র হয়ে অতীতের সেই অমোঘ সত্য অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। আমাদের সকলের পূর্বপুরুষগণ সিন্ধুর তীরে বাস করত। সিন্ধু থেকেই হিন্দু কথাটির উৎপত্তি। সেই অর্থে আমরা সকলেই হিন্দু। স্বীকার করেও অস্বীকার করে বসল। মূর্খের ভাষায় বলল, কিন্তু এখন তো আমাদের জাতি ভিন্ন, ধর্ম ভিন্ন।
রঞ্জনা উত্তর দিল, ফিরোজ সাহেব, আমার স্বামী মার্কসবাদী হলেও স্বীকার করেছেন, উনি হিন্দু। আবার উনি নাস্তিক হলেও তাতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব মুছে যায় না। গেরুয়া বসন না পরলেও অধার্মিক নন, বলা যায় না। একইভাবে আপনিও হিন্দু। আর আপনি যদি নিজেকে হিন্দু বলেন, তা হবে গর্বের বিষয়। কেন, জানেন? হিন্দু কোন জাতি বা প্রচলিত ধর্ম নয়। হিন্দু ভারত ভূখণ্ডের এক সংস্কৃতি, জীবনদর্শন, মানবধর্ম, বিশ্বমানবতার পথপ্রদর্শক, সাম্যের আধার। মুখে একবার বলেই দেখুন না, ‘এই ভারত তথা বাংলা মায়ের সন্তান আমরা, আমরা সকলেই হিন্দু।’ কত তৃপ্তি! কত শান্তি! হৃদয়ে অনুভূত হবে, বলে বোঝাতে পারবো না। এখানে বৈষম্যের বিষবাষ্প নেই। আমি প্রফুল্ল চিত্তে, গর্বের সাথে বলছি, ‘আমি হিন্দু। হিন্দুত্ব আমার আদর্শ। বাঙালি আমার পরিচয়। বাংলা আমার মা। সনাতন আমার ধর্ম, যা সত্য। সত্যের পূজারী আমি।’
ফিরোজ সাহেব ভাবতে বসলেন। রাতের ঝিঁঝিদের কোলাহলে মুখরিত হলো রাত। আজকের মত আড্ডার সমাপ্তি হল।
রবিবার বিকেল পাঁচটা। পরিমলবাবু বসে পড়েছেন টিভির সামনে। এটা তার নিত্য অভ্যাস। বাংলা একটি চ্যানেলে খবর হচ্ছে। ‘চারিদিকে চাপা উত্তেজনা। পদ্মাপারের হিন্দুদের আর্তনাদ গঙ্গাপারেও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্রতিনিয়তই বিতাড়িত হিন্দুরা গোপনে এপারে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে, কেউ ধরা পড়ে জেলে যাচ্ছে।…….।’
পূর্ব কথামতোই আজ ঠিক সন্ধ্যাবেলায় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্ররা পরিমলবাবুর বাড়িতে এসে হাজির হল। তবে সেলিম আসেনি। এসেছেন ফিরোজ সাহেবও। সেলিমকে নিয়ে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। পরিমলবাবু শুধোলেন, কী হয়েছে সায়ন? স্যার, সেলিমের বাবা মহম্মদ আখরুজ্জামান, বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনের নেতা। গতকাল চট্টগ্রামের এক হিন্দু নেতার স্ত্রীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। তাতে নাম জড়িয়েছে ওই আখরুজ্জামানের। আজ সকালে ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো খবরটা ঢালাও করে প্রচার করেছে। জানাজানি হতেই ওরা পরিবারশুদ্ধ এখান থেকে গা ঢাকা দিয়েছে। ওদের দু’দেশেই বাড়িঘর আছে।
বলরাম বলল, স্যার, জিহাদিরা ঢাকার ইসকন মন্দির আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। ওখানকার দু’জন সন্ন্যাসী মরণাপন্ন। খুলনায় জিহাদিরা হাতে বন্দুক, দা, কুড়াল, তলোয়ার নিয়ে মিছিল করছে। স্লোগান দিচ্ছে, ভাইজানেরা কবুল কর্, হিন্দু দেখলেই জবাই কর্।
পরিমলবাবু শিউরে উঠলেন। ফিরোজ সাহেব বললেন, যা বলছো, তা যদি সত্য হয়, তবে নিন্দার কোনো ভাষা নেই। পরিমলবাবু প্রতিবাদের সুরে বললেন, ফিরোজ, সত্য না হলে টিভি চ্যানেলগুলো দেখাতে পারে? দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের ছাত্র দাদা অনির্বাণও ভাই সায়নের সাথে এসেছে আজ। তার ভেতরে উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ ঘটল, স্যার, এমন বর্বর জাতি ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এরা উগ্র, হিংস্র, মানব সভ্যতার কলঙ্ক।
অনির্বাণ, কথাগুলো সকলের জন্য খাটে না। তোমার বয়স অল্প, তুমি হয়তো জানো না, বরকত, সালাম, জব্বার, রফিক আরও কত তরুণ জীবন আহুতি দিয়েছিল বাংলা ভাষাকে রক্ষা করবার জন্য। বাংলা যে ছিল তাঁদের মায়ের ভাষা। সেদিন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে কোন এক শিল্পী গেয়ছিল,’আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি!’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কত মহান ব্যক্তি ছিলেন। বাংলা ভাষাকে রক্ষা করবার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশমাতৃকার চরণতলে। দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারত। বন্ধুর অন্ধকারময় পথের শেষে মিলল আলোর দেখা। এল আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হল, ‘জয় বাংলা’, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। সেই ইতিহাস ভুলি কী করে? আজ মৌলবাদীরা ওপার বাংলাকে বিষিয়ে তুলেছে। হ্যাঁ, অনেক শান্তিপ্রিয়, সম্পৃতিকামী মুসলমানও মৌলবাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলছে। অশিক্ষা-কুশিক্ষায় লালিত-পালিত তরুণেরা বিষাক্ত, বিধ্বংসী স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। তাদের অন্তরে ফুলের সুবাস পৌঁছায়নি।
স্যার, আপনার কথাগুলো বেদবাক্য হিসেবে আমার শিরোধার্য হোক। তা সত্ত্বেও একথা না বলে পারছি না যে, বেইমানের উপাদান ওদের রক্তে আছে। যে হিন্দুস্থান ওদের জল, খাদ্য, আলো, কতকিছু দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, মানবতার চিরশত্রু পাকিস্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত করেছে, সেই হিন্দুস্থান চরমতম শত্রু, আর পাকিস্তান হয়ে গেল ওদের বন্ধু? না স্যার, এই কথাগুলো আপনাকে মানতেই হবে। হিন্দুরা সহনশীল, সংযমী, ধৈর্যশীল। আর ওপারের ওই বেইমানদের গায়ে আছে ঔরঙ্গজেব, মীরজাফরের রক্ত। সেই রক্তে মিশে আছে হিংস্রতার বীজ, ব্যভিচারের বাসনা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অতীতে একদা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাবের পতনের অন্যতম একটি কারণও ছিল এই ব্যভিচার।
সায়ন ও অন্যান্যরা অনির্বাণের কথাগুলোকে জোরালো সমর্থন করল। রঞ্জনাদি চা-বিস্কুট নিয়ে এসে শেষ কথাগুলো শুনছিল। সেও সমর্থন জানিয়ে বড়দের উদ্দেশ্যে বলল, দেখ, ওরা আমাদের পুত্রসম। তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা গোমাতার পুজো করি। তাঁর বুকের সুমিষ্ট দুধ পান করে বেঁচে থাকি। ঠিক যেমন আমাদের সন্তানেরা মায়ের দুধ পান করে বেঁচে থাকে। কিন্তু কোন সন্তান কি মায়ের মাংস কেটে খেতে পারে? যারা তা পারে, তারা সহনশীল, সংযমী, ধৈর্যশীল কেমন করে হবে? আমাদের মুনি-ঋষিগণ নিরামিষাসী ছিলেন বলেই জীবনকে এক উচ্চ মার্গে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। বিদ্যাসাগরের যুগে সমাজের একজন মনীষী, বিজ্ঞানসাধক ‘অক্ষয় কুমার দত্ত’ও নিরামিষ আহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
রঞ্জনা, আমরা কারও ধর্মে আঘাত দিতে চাই না, পরিমলবাবুর কথার প্রত্যুত্তরে রঞ্জনাদি বিনয়ের সাথে বলল, ওগো, আমিও চাই না। কিন্তু আজকের অশান্তি, সমাজ ধ্বংসের মূলে যা কিছু, তা তো আমাদের নবীন প্রজন্মের জানা উচিত। কী ক্ষতিকারক একটা প্রথা! ‘চাচা আপন, চাচী পর, চাচীর মেয়ে বিয়ে কর্।’ মেয়ে তো সেই চাচারই। রক্তের সম্পর্ক। কী ফিরোজ সাহেব, ডাক্তারি শাস্ত্র কী বলে? কথায় কথায় আপনি বলেন, ইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এই তার নমুনা? ব্যভিচার বলবো না তো, একে কী বলবো? অথচ এই বিধান শরিয়ত অনুমোদন করে। বহুবিবাহ, বহু নারীভোগ শরিয়ত অনুমোদন করে।
দেখুন বৌদিদি, এসব বলে ইসলামকে ছোট করলে অন্যায় হবে। আসলকথা কী জানেন, মুসলমান জাতি এখনও সেভাবে শিক্ষার আলোয় আসতে পারেনি।
কিন্তু ফিরোজ সাহেব, শিক্ষার আলো তো আপনার মধ্যে আছে। তাহলে তৃতীয় স্ত্রীকে ঘরে আনলেন কেন? প্রথমজনকে তালাক দিয়েছেন। দ্বিতীয়জন তো ঘরেই আছে। শুনেছি, তৃতীয়জন আবার আপনারই মায়ের আপন বোনের মেয়ে।
ফিরোজ সাহেব লজ্জায়, অপমানে উঠে চলে যাচ্ছিলেন। দরজার কাছাকাছি গিয়ে রাগে বিড়বিড় করে বললেন, তোমরা আমাদের ধর্মের নামে যতই নিন্দা করো না কেন, এই বাংলায় শুধু নয়, এই ভারতেও একদিন আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবো। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছি। সব হিসেব বুঝে নেবো। সেদিন নিকটেই।
অনিকেত বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকছিল। কথাগুলো স্পষ্ট কানে এল তার। তবুও সম্মানের সাথে বলল, চলে যাচ্ছেন স্যার?
পরিমলবাবু বৃথাই পিছু ডাকলেন। অনুরাগে স্ত্রীকে ধমকালেন, অপ্রিয় কথাগুলো বলতে গেলে কেন? দেখ রঞ্জনা, বহুবিবাহের মতো কিছু সামাজিক ব্যাধি একদিন হিন্দু সমাজেও ছিল। এখনও কেউ কেউ সেই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
হিন্দু সমাজ সেই ব্যাধির নিরাময় করেছে। বহু যুগ আগে প্রাচীনকালে হিন্দু রাজারাও বহুবিবাহ করতো। হিন্দু সমাজে তখন নানা কুপ্রথা ছিল। অনেক অন্যায় অধর্ম হত ঠিকই। সেই কালিমা শিক্ষার আলোয় সব মুছে গেছে। অন্ধকার এখনও কোথাও থাকলেও হিন্দু সমাজ তা অনুমোদন করে না। কিন্তু মুসলমানেরা, বিশেষ করে ওদের পুরুষেরা সেই আদিমতাকে মনন জগতে পুষে রেখেছে। কী নৃশংস ওরা, বলতো! কথায় কথায় স্ত্রীকে কেটে ফেলে। মা-বাবা, ভাই, দাদাকে কেটে ফেলে। হাত একটুও কাঁপে না। অন্য ধর্মের মানুষ হলে ওরা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে তো তাই চলছে।
রঞ্জনা, এবার আমি তোমার সাথে একমত। কিন্তু মুশকিল কী জানো, আমাদের মধ্যেও অনেক মানুষ আছে, যারা তোমার কথাগুলোকে সমর্থন করবে না, বরং সাম্প্রদায়িক বলে গালি দেবে।
তারা প্রকৃত হিন্দু নয়, ভেজাল। হিন্দু সমাজে তারাও সমান বিপজ্জনক। তারাই এখন হিন্দু-ঐক্য সাধনে বাধার সৃষ্টি করছে।
এটা অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলেছ । হিন্দুরা জোটবদ্ধ না হলে বাঙালির অস্তিত্ব লুপ্ত হবে। হারিয়ে যাবে বাংলা ভাষা।
রাত অনেকটাই হয়েছে। ছাত্ররা চা খাওয়ার পর উঠে দাঁড়ালো। অলোক অভয় দিল, স্যার, মনোবল হারালে চলবে না। বাঙালির বাংলা ভাষা আমরা হারিয়ে যেতে দেব না। জগতসভায় রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে শ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছেন। সায়ন বলল, ‘হিন্দু ধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম’, একথা স্বয়ং বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্মমহাসভায় উদাত্ত কণ্ঠে বলে গেছেন। আসুন, আমরাও সেই সুরে সুর মেলাই। “বিপ্লবী বীর বিবেকানন্দ, ……….।”
এরপর ছাত্ররা চলে গেলে পরিমলবাবু টিভি চালিয়ে খবর শুনতে লাগলেন। দেখলেন, ওপারের গোপালগঞ্জে এক মৌলবাদী নেতা ফতোয়া জারি করছেন, ‘বাংলাদেশের সমস্ত হোটেলে গরুর মাংস রাখতে হবে। কোন হোটেল গরুর মাংস না রাখলে সেই হোটেল তো বন্ধ হবেই, মালিকেরও কঠিন শাস্তি হবে।’ এরপর অন্যত্র দেখলেন, প্রকাশ্য রাস্তায় একজন হিন্দু যুবতী মেয়েকে ঘিরে ধরে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলতে বলতে মারধর করা হচ্ছে। মেয়েটির মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। ওর নাম জানা গেল, ‘ইতিমা মন্ডল’, একজন অভিনেত্রী। যন্ত্রণা আর সইতে না পেরে টিভি বন্ধ করে দিলেন তিনি।
শীতের রাত-দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হল। সাথে উত্তরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। তবু শরীরের উত্তাপ কমল না। সারারাত ঘুম ধরল না চোখে।
পরদিন ভোরে নির্মম একটা খবর এলো। চট্টগ্রামে তার খুড়তুতো ছোট ভাইয়ের বাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একটাই মেয়ে, নিরুদ্দেশ। পরিমলবাবু, রঞ্জনাদি যন্ত্রণায় মুহ্যমান হয়ে পড়লেন।
ঠিক দু’দিন পর। বেলা বাড়তেই পথ চলতি লোকের কোলাহল ভেসে এল। ‘বাংলাদেশে আগুন জ্বলছে। একের পর এক মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দু-নিধন চলছে ঢাকা, খুলনা, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সব জেলাতেই। লক্ষ লক্ষ অসহায় হিন্দু উদ্বাস্তু ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে প্রাণ হাতে নিয়ে রওনা হয়েছে ভারতের দিকে।’
রঞ্জনাদিদি, পরিমলবাবু উত্তর দিকের জানালাটা খুলে দিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। দেখলেন, প্রিয় ছাত্ররা দৌড়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই রুদ্ধশ্বাসে বলছে, স্যার, মুসলমানরা আসছে কলকাতা দখল করতে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান বাংলাদেশে এসে বলেছেন, যুদ্ধ হবে। উনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ভারতকে। স্যার, এই যুদ্ধ হবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নয়, পাকিস্তানের। ওদেশের যুদ্ধ বিমান বাংলাদেশে এসে পৌঁছে গেছে। ওরা আমাদের বাংলা,বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ত্রিপুরা দখল করে নেবে। এদেশের অনেক মুসলমানও তালে-তাল দিচ্ছে। এখানে মিছিল করছে। বক্তৃতা করছে। পাকিস্তানের জয়গান গাইছে। আরও অবাক হবার মতো ঘটনা স্যার। ফিরোজ স্যারকে দেখলাম ওদের মিছিলে। আমাদের সামনে তবে মহা বিপদ। বিষয়টাকে হালকাভাবে নিলে পলাশীর যুদ্ধের মতোই বড় ভুল হয়ে যাবে। হিন্দুরা এপারে একজোট নয়। দুই পারের মুসলমানরা একজোট। ভয়ঙ্কর পরিনতি নেমে আসবে, স্যার।
ইতিমধ্যে অদূরে কোন জনসমাবেশ থেকে ভেসে আসছে কোন এক নেতার ভাষণ। “হিন্দু ভাইয়েরা, বোনেরা, বাবা-মায়েরা, ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আমাদের সমূহ বিপদ, যদি না আমরা একজোট হয়ে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে সামিল না হই। দেশভাগের, বাংলা ভাগের যন্ত্রণা আমরা ভুলিনি। স্বাধীন বাংলাদেশকে আবার নতুন করে পূর্ব পাকিস্তান করবার চক্রান্ত সফল হয়েছে। এপার বাংলার অস্তিত্বও মুছে দিতে চায় পাকিস্তানপন্থী জল্লাদেরা। ওদের দূরভিসন্ধি সার্থক হলে গঠিত হবে বৃহত্তর পাকিস্তান। বড় দুর্ভাগ্যের দিন ঘনিয়ে আসছে এপারের হিন্দুদের কাছেও। ……..।”
একরাশ উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ নিয়ে পরিমলবাবু বললেন, গভীর ষড়যন্ত্র। ভারতকে খিলাফত রাষ্ট্র করতে চায়। জিজ্ঞেস করলেন, সায়ন, বলরাম, অনন্ত, কে ভাষণ দিচ্ছেন? স্যার, এক হিন্দু নেতা। আমাদের বাংলার অস্তিত্ব, বাংলা ভাষা, হিন্দু সংস্কৃতিকে রক্ষার লড়াইয়ে সামিল হতে সকল হিন্দুকে কাতর হয়ে ডাকছেন। ঐ দেখুন স্যার, দলে দলে হিন্দুরা এগিয়ে চলেছে।
চলো, আজ আমিও সামিল হব। আমরা সবাই সামিল হব।
স্যার, বহুকাল ধরে আপনি তো মার্কসবাদী ছিলেন। গান্ধীজিকেও মনে প্রানে শ্রদ্ধা করেন।
না অনন্ত। আজ আর মার্কসবাদ, গান্ধীবাদ নয়। আজ থেকে আমি হিন্দু। হিন্দুত্ব আমার আদর্শ। এই বাংলা আমার মা। তাকে রক্ষা করাই আমার ধর্ম। তোমরা সবাই বলিষ্ঠ কণ্ঠে বল, “দুনিয়ার হিন্দু, এক হও।”
শুরু হল দৃপ্ত তেজে পথ চলা। সায়নের কন্ঠে আজ নতুন গণসংগীতঃ
জাগো হিন্দু, ওঠো হিন্দু, এসো হিন্দু,
দিকে দিকে ঐ উঠেছে কলরব,
এসো মিলি একসাথে,
ধরো হাতে-হাত কাছে এসে,
নইলে বাংলা মায়ের বড় বিপদ।
শত্রুরা আজ হানছে আঘাত,
ডঙ্কা বাজিয়ে গাইছে জিহাদের গান,
এই বাংলাকে করবে পাকিস্তান,
ওগো, এই বাংলার হিন্দু যত,
চেয়ে দ্যাখো ঐ, চলছে হিন্দু-নিধন,
শুনতে কি পাও মায়েদের কান্না,
নির্যাতিতা বোনেদের আর্তনাদ,
বাংলা মায়ের বড় বিপদ।
বাংলা মোদের মাতৃভাষা,
বাংলা মোদের প্রাণের ভাষা,
শত্রুরা কেড়ে নিতে চায়,
সভ্যতার আলো মুছে দিয়ে
অন্ধকার নামাতে চায়,
হাসছে ঐ অট্টহাসি,
ওরা নয়তো মানুষ, হৃদয়হীন জল্লাদ,
বাংলা মায়ের বড় বিপদ।
জাগো হিন্দু, ওঠো হিন্দু, এসো হিন্দু,
———————
নইলে বাংলা মায়ের বড় বিপদ।।
……………………………………………………….