(নিবন্ধ) |
হিন্দু-ঐক্যের পথ কণ্টকাকীর্ণ | – হরবিলাস সরকার |
একতাই বল। একতাই শক্তি। বর্তমান সময়ে মুসলিম মৌলবাদ যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং জিহাদ ঘোষণা করেছে, তাতে হিন্দুদের সামনে ঘোর বিপদ। জিহাদে জয়ী হলে মুসলিম আধিপত্যের বিস্তার ঘটবে ভারত উপমহাদেশের দিগন্ত জুড়ে এবং একদিন হিন্দু জাতি অবলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রমাণ তো চোখের সামনেই। অখন্ড ভারত বহু খন্ডে বিভক্ত হয়েছে। সিন্ধু-পার হিন্দুদের বাসভূমি। আজ পাকিস্তান, আফগানিস্তানে হিন্দুর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষায় অনেকেই আবার মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে চলছে হিন্দু-নিধন যজ্ঞ। সেখানেও হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। না হলে তাদের বিতাড়িত করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হিন্দু-শূন্য বাংলাদেশ তৈরি করা।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও ভালো নয়। খবরে প্রকাশ, জিহাদিরা ডেরা পেতেছে গোটা রাজ্য জুড়ে। অসংখ্য মাদ্রাসার খোঁজ মিলেছে, যেগুলোতে চলছে জঙ্গি প্রশিক্ষণ। প্রশাসন অন্ধ, নির্বিকার। সরকার উদাসীন। কেনইবা নয়? মুসলমান-প্রীতি বারবার জয়ের স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্ন সফলও হয়। জিহাদিরা শুভাকাঙ্ক্ষী। তাদের সহযোগিতা পেয়ে যদি ধন্য হওয়া যায়, এই সুযোগ কেন হারাবেন? প্রয়োজনে মুসলিম বেশে ইফতারে গিয়ে নামাজ পড়বেন। ক্ষমতার লোভ দু’চোখ অন্ধ করে রেখেছে। তাতে যদি পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের মতো পরিণতি লাভ করে, ক্ষতি কী? সিংহাসন তো বাঁচবে।
বামপন্থী আর অহিংসবাদীরাও ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আউড়ে কার্যত পরোক্ষে ‘জিহাদের স্বপ্ন পূরণে’ সহযোগিতা করছেন। কীভাবে? ইসলাম শান্তির কথা বলে। কিন্তু ইসলামের অনুগামীরা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার মর্ম বোঝে না। রক্তে ওদের পরধর্ম বিনাশের আকাঙ্ক্ষা। অপরিমেয় আকাঙ্ক্ষায় মনে বাসা বাঁধে জেদ। তাই আজ ইসলাম দিকে দিকে জিহাদের জন্ম দেয়। ‘গাজ-ওয়াতুল-হিন্দ’ ইসলামের ভবিষ্যদ্বাণী। জিহাদিরা চায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে। ওরা গোটা ভারতে ইসলামের পতাকা ওড়াতে চায়। চরম সংকট এবং মন্দার যুগে বেকারত্ব যখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি দারিদ্র্যের একটি অন্যতম কারণ। হিন্দুরা তা বোঝে। কিন্তু জিহাদিদের তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই।
এখন কথা হল, বাইরের শত্রুপক্ষ বা বিরোধীরা আক্রমণের নানা কৌশল অবলম্বন করতেই পারে। আমাদের কাজ হল, তা প্রতিহত করা। কিন্তু প্রতিহত করতে গেলে নিজের ঘরটাকে তো শক্তপোক্ত করতে হবে। তা যদি দুর্বল হয়, শত্রুপক্ষের জয় অবশ্যম্ভাবী। একারণে শত্রুর সমালোচনার থেকে অত্যন্ত জরুরি আপন ঘরের জীর্ণদশা মেরামত করা। হিন্দু-ঐক্যের পথে কোথায় বাঁধা, তা কাটিয়ে ওঠা। তাহলে কিছু কথা বলি।
আমাদের অতীতের পূর্বপুরুষদের দ্বারা সৃষ্ট বর্ণাশ্রম প্রথা হিন্দুদের মধ্যে চরম বিভেদের সৃষ্টি করেছে। সেই সমাজে কী প্রয়োজনে তা সৃষ্টি করতে হয়েছিল, জানা নেই। কিন্তু আজকের সমাজে তার অবলুপ্তি প্রয়োজন। জ্ঞানার্জনের সুযোগ ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে দলিত, শূদ্ররা আজ উপরের সারিতে উঠে এসেছে। তাহলে উঁচু-নিচু, ছোট-বড়ো’র বেড়াজালটা সরিয়ে ফেলতে বাঁধাটা কোথায়? আজকের দিনেও কেউ যদি কন্ঠে পৈতা ধারণ করে গর্ববোধ করে, আমি ব্রাহ্মণ। এ তো বড়ত্বের অহংকার, তবে তো বিভেদ চিরতরেই থাকবে। এ এক দূরারোগ্য ব্যাধি। শুধু মুখে সাম্যের বাণীতেই এ ব্যাধি সারবে না। ওই বিভেদের মূল শিকড়টা উপড়ে ফেলতে হবে। হ্যাঁ, একথা সত্য যে, যোগ্যতা এবং জ্ঞানের পার্থক্য থাকবে। তার জন্য ওপরে ওঠার বা সমসারিতে আসার প্রতিযোগিতা নিশ্চয়ই থাকবে। সংস্কারের ক্ষেত্রে কোন মলিনতা থাকলে সুশিক্ষার আলোয় তা মুছে যাবে।
মুসলমানরা একজোট কেন? শিয়া, সুন্নি, খান, পাঠান, মোগল আজ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রোটেষ্টাণ্ট, ক্যাথলিকের তফাৎ চোখে পড়ে না। তাহলে আমরাই বা কেন পারিনা বিভাজন তুলে দিতে?
ঘরের মানুষেরা এক হয়ে থাকলে বাইরের প্রবল শক্তিধর শত্রুকেও রুখে দেওয়া সম্ভব। আমরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের দোহাই দিই, ভোটে কারচুপি, বুধ দখলের অভিযোগ তুলি। কিন্তু এসবের উপরেও যা প্রয়োজন তা হল হিন্দুত্বের পূজারি সকল মানুষকে আপন করে নেওয়া। আমরা আজও অস্পৃশ্যতা, ছুঁৎমার্গ ভুলে সকলকে হৃদয়ে স্থান দিই না। কাউকে মিছে ভালোবেসে কাছে টানলে গোপন বিচ্ছেদ-ব্যথায় সে দূরেই সরে যায়। জোর করে, লোভ, ভয়-ভীতি দেখিয়ে হৃদয়ের বন্ধনে বাঁধা যায় না। একারণেই প্রতিবেশী কেমন আছে, খোঁজখবর নিলে, মিষ্টি হাসি হেসে বলে ‘ভাল আছি’, ভোট আর কেউ দেয় না।
আমাদের মন যদি এক না হয়, আমরা এক হব কী করে? মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দেবো। পাত্রের সন্ধান করছি। ফোনের ওপার থেকে যদি বলে, আপনারা তো ‘অমুক’ সম্প্রদায়, না না, অতটা নিচে নামতে পারবো না। এখনও কোনো দলীত উঠোন পরিত্যাগ করলে ঐ স্থান গঙ্গাজলে শুদ্ধ করে নেওয়া হয়। আমাদের সংবিধানের স্রষ্টা শ্রদ্ধেয় ‘আমবেদকর’কেও অনেক লাঞ্ছনা, ঘৃণা সইতে হয়েছে। আমরা তাঁর গলায় মালা দিই, কিন্তু মনের বন্ধন তৈরি করতে পেরেছি কি?পারিনি।
মার্কসবাদীরা কিন্তু অন্যরকম। তারা এক্ষেত্রে এগিয়ে। ছুঁৎমার্গ, অস্পৃশ্যতা নেই। বড়ত্বের অহংকার নেই। হিন্দু-অহিন্দু এক থালাতেও বসে ভাত খেতে পারে। ব্রাহ্মণ হয়েও গলায় পৈতা পরে না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য,শূদ্র,দলীত সব ওখানে মিলেমিশে একাকার।
ওরা যা পারে, আমরা সিন্ধু-পারের মানুষ, হিন্দুত্বের পূজারি হয়ে তা পারিনা কেন? তাহলে একথা বলার কী যৌক্তিকতা, সার্থকতা যে, এই মহান ভারত হিন্দুর বাসভূমি? আমরা যদি এক দেশ, এক পরিবার হতে না পারি, তবে ‘আমি হিন্দু’, ভারত আমার মা ‘ভারতমাতা’,এই বলে কি শুধুই মিছে গর্ববোধ করা হবে না? তাহলে এর চেয়েও বড় কথা কেমন করে বলবো, “ভারতের হিন্দু এক হও, দুনিয়ার হিন্দু এক হও?”
বৈচিত্র্য আর বিভেদ সমার্থক হতে পারে না। বৈচিত্র্য থাকুক জ্ঞানে, রঙে, ভাষায়, পোশাকে। বৈচিত্র্য থাকুক পাহাড়,নদী, ঝরনায়। যেমন একই আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা-কালো মেঘেরা। একই আকাশ রঞ্জিত হয় ভোরের সোনালি আলোয়, গোধূলির আবির-আভায়।
ভয়ে, আত্মরক্ষার কারণে আমরা জোটবদ্ধ হই বা কোনো বিশেষ শর্তে জোটবদ্ধ হই বা আন্দোলনে সাফল্য পেতে জোটবদ্ধ হই। যেকারণেই জোট বাঁধিনা কেন, সে জোট দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যদি আপনার হয়ে হৃদয়ে-হৃদয়ে বন্ধন রচনা করি, তবে সে জোট চিরস্থায়ী হয়।
পরিশেষে যে কথা বলার,তা হল, শুধু বক্তৃতার দ্বারা লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। বক্তৃতায় আবেগ তৈরি হয়, সত্য। আবেগ কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রয়োজন সমস্ত অজুহাত ভুলে, সময় নষ্ট না করে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছানোর। সেই সময় এসেছে এখন। সংগঠন শক্তিশালী না হলে, আপনজনদের এক সূত্রে বাঁধতে না পারলে হিন্দু-ঐক্য কীভাবে গড়ে উঠবে? লক্ষ্য অধরা থাকলে বিরোধীরা, শত্রুরা চিরদিন অট্টহাসি হাসবে।
…………………………