![]() |
নাটিকা – আলোহীন পাঠশালা (কল্পনাপ্রসূত ) – হরবিলাস সরকার |
বাংলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম ‘দুর্ভাগ্যপুর’। এখানকার সিংহভাগ মানুষই দারিদ্র্যপীড়িত, দিনমজুর। দুর্ভাগ্যের ঘনঘটার মধ্যেও তারা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠায় শিক্ষা লাভের আশায়।
(মায়ের প্রবেশ ছেলেকে লাঠি হাতে মারতে মারতে)
আরতীঃ আজ তোকে আমি মেরেই ফেলবো। আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তোর আজ কিছুতেই রক্ষে নেই। একেবারে মেরেই ফেলবো।
আকাশঃ মা রে, আর মারিস্ না। তুই আমারে আর মারিস্ না।
আরতীঃ ঠিক আছে, মারবো না। তাহলে বল্ – ইস্কুলে যাবি?
আকাশঃ আমি তো যেতেই চাই। তুই আমাকে খাতা, কলম কিনে দে। খাতা-কলম না নিয়ে গেলে স্যার যে বকে। রোজ রোজ বকা খেতে আমার ভালো লাগে না। (কেঁদে ফেলে)
আরতীঃ (লাঠি ফেলে দিয়ে সান্ত্বনা দেয়) কাঁদিস্ না। কাল ঠিক তোর খাতা, কলম কিনে দেবো। সোনা আমার, আজ তবে যা স্কুলে।
(আজাদ আর তার মা ‘সুফিয়া’র প্রবেশ)
সুফিয়াঃ কীগো আকাশের মা, আকাশ যাবে না স্কুলে?
আরতীঃ দেখো না দিদি, খাতা-কলম কিনে দিতে পারিনি বলে বলছে – যাবে না। ঘরে এক মুঠও খাবার নেই। ইস্কুলে গেলে তো দুটো খেতে পাবে। আকাশের বাপ এ মাসে কোনো টাকা পাঠায়নি। দিল্লিতে কী সব জ্বর হচ্ছে। ওর বাপও জ্বরে পড়েছিল। কাজ-কাম সেভাবে করতে পারেনি। এখন কেমন আছে, কী খায়, কিছুই জানিনা। আমি দুশ্চিন্তা করবো বলে ফোনেও কিছু বলে না। (কাঁদে, চোখের জল মোছে)
সুফিয়াঃ বোহিন, আমার মনের অবস্থাও ভালো নয়। আজাদের আব্বু তো এখানে কাজ-কাম নেই বলে ঠিক করেছে – বাইরে চলে যাবে। আমার বিড়ি বাঁধার পয়সাতেই সংসারটা কোনরকমে চলছে। ছেলের খাতা, কলম আমিও কিনে দিতে পারিনি। তোর ছেলের মতোই বায়না ধরেছিল। বুঝিয়ে-সুজিয়ে নিয়ে এলাম। ভাবলাম – আকাশ যদি স্কুলে যায়, ওর সঙ্গে চলে যাবে।
আকাশঃ সুফিয়া মাসি, খাতা-কলম কিনতে কত টাকা লাগবে গো?
সুফিয়াঃ টাকা তো অনেকই লাগবে। কিন্তু বাপ, সেই নিয়ে তুই ভাবিস্ না। তবে তুই যখন আমাকে মাসি বলে ডাকিস্, তোকে বলতেই পারি – মাকে দুঃখ দিস্ না। কত দুঃখে তোর মায়ের চোখের জল ঝরছে। আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝতে পারবি।
আরতীঃ দিদি, ক’দিন ধরে আমারও কাজ নেই। আজ একটা কাজের খোঁজ পেয়েছি। ভাবছি – যাবো।
আকাশঃ (মায়ের চোখের জল মুছে দেবে) তুই তাহলে মা কাজে চলে যা। আমি আজাদকে নিয়ে স্কুলে চলে যাচ্ছি।
আরতীঃ তাই যা। আজ তো ঘরে দুটো বিস্কুটও নেই যে, তোর মুখে দেবো।
আকাশঃ তুই আমার জন্য ভাবিস্ না মা। স্কুলে তো রান্না হবে। আজ আমাদের ডিম দেবে রে। মা, তোর জন্য আমি ডিমটা নিয়ে আসবো। কতদিন তুই ডিম খাস্ নি!
আরতীঃ না ব্যাটা, ডিম তুই নিয়ে আসবি না। খেয়ে আসবি।
সুফিয়াঃ দেখেছিস্ বোহিন, ব্যাটা তার মায়ের জন্য কত ভাবে! একটু আগেও আমি কতই না ভুল বুঝেছিলাম। পরাণের টান, আর মা বলে কথা।
আজাদঃ আম্মিজান, আমিও তোমার জন্য ডিম নিয়ে আসবো।
সুফিয়াঃ না সোনা, ডিম তুমি স্কুলে খেয়ে আসবে।
আরতীঃ দিদি, আমাদের ব্যাটাদের পেটে শিক্ষা নেই। কত দুঃখ, কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটছে, তবু অমানুষ হয়ে যায়নি। জানিনা, কতদিন ভেতরে এই সুবুদ্ধি থাকবে।
আকাশঃ মা, জামা-প্যান্ট খুব ময়লা হয়ে গেছে। ম্যাম বলেছেন – গরম জলে সোডা দিয়ে কাচতে। খরচ নাকি অনেক কম। আরও বলেছেন – ছেঁড়া হোক, লজ্জার কিছু নেই, জামা-প্যান্ট যেন পরিস্কার থাকে। আজ তাহলে একটু সোডা নিয়ে আসিস্ মা। (স্কুলের ছেঁড়া ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেবে)
আজাদঃ আম্মিজান, তুমিও একটু সোডা কিনে নিও। আর বিড়ি বাঁধার পয়সা পেলে খাতা-কলমও কিনে নিও। আজ নাহয় রাতের খাবারটা খাবো না। বুঝেছো আম্মিজান? আমি আসছি।
( দু’জন স্কুলের পথে রওনা হয়ে যাবে)
সুফিয়াঃ বোহিন রে, আজ ছেলে আমার রাতের খাবার খাবে না। ঐ পয়সা দিয়ে খাতা, কলম কিনতে বলল। এমন কথাও ছেলের মুখে শুনতে হল। এই দুঃখ সই কেমনে! চল্, তুই তো কাজে যাবি। আমিও বাড়ি যাই, বিড়ি বাঁধি গিয়া।
(মায়েরা চোখের জল মুছতে মুছতে চলে যাবে)
গ্রামের মাঝে ‘দুর্ভাগ্যপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়’। ক্লাস শুরুর সময় হয়েছে। প্রধান শিক্ষিকা আজ একা। সব ঘরের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এসে একটা ঘরে বসাচ্ছেন। শুরু হবে পঠন পাঠন।
প্র: শিক্ষিকাঃ (হাজিরা খাতা হাতে) তোমরা সবাই চুপটি করে বসো। কেউ গন্ডগোল করবে না। আর শোনো, আজ থেকে ১০-১২ দিন আমি তোমাদের সবাইকে একাই পড়াবো।
ছাত্র-ছাত্রীরাঃ ম্যাম, পরান স্যার আসবে না?
প্র: শিক্ষিকাঃ না, পরানবাবুর আজ বি.ডি.ও অফিসে ট্রেনিং আছে। কাল থেকে ওনাকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে একটা কাজ করতে হবে।
আশাঃ ম্যাম, এখন তাহলে আমরা কী বই পড়বো?
আফসানাঃ কিছু লেখাবেন ম্যাম?
প্র: শিক্ষিকাঃ হ্যাঁ, তোমরা সবাই খাতা বের করো। (সবাই খাতা বের করবে) যারা লিখতে পারো, তারা দেখে দেখে এক পাতা বাংলা হাতের লেখা লেখ। যারা লিখতে পারো না, তারা যে কোনো একটা ছবি আঁকো। আর যারা কিছুই পারো না, তারা কথা না বলে গোল হয়ে বসে খেলা করো। আমি রাঁধনি মাসিদের রান্নার জিনিসগুলো দিয়ে আসি।
(ছাত্রছাত্রীরা নির্দেশমতো যে যার কাজ করতে উদ্যত হবে। প্রধান শিক্ষিকার প্রস্থান)
(কিছুক্ষণ বাদেই প্র: শিক্ষিকার অবর্তমানে ছাত্রছাত্রীরা বইখাতা ফেলে হইচই শুরু করবে)
আজাদঃ এই আশা, আফসানা, ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ’ খেলবি?
আশা, আফসানাঃ হ্যাঁ, খেলবো।
আজাদঃ তাহলে শুরু করছি। প্রথমে আমিই কানামাছি। (শুরু হয় খেলা)
“ কানামাছি ভোঁ ভোঁ
যাকে খুশি তাকে ছোঁ।
কানামাছি ……………।”
( এভাবে একে একে আশা, আফসানা, আকাশ ‘কানামাছি’ হবে। খেলা চলতে থাকবে)
( প্রধান শিক্ষিকার প্রবেশ)
প্র: শিক্ষিকাঃ কী ব্যাপার, তোমরা লেখাপড়া না করে খেলা করছো, আর হইচই করছো? এসব করলে তোমাদের পড়াশোনা হবে ? বেশ, ঠিক আছে। তোমরা এবার সবাই ছবি আঁকো। আমি মিড ডে মিলের হিসাবটা সেরে নিই, কেমন ? তারপর আবার রিপোর্ট পাঠাতে হবে। (প্রধান শিক্ষিকা হিসেবের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন)
( ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ ছবি আঁকতে আঁকতে ঘুমিয়ে পড়বে)
আশাঃ ম্যাম, আকাশ ঘুমোচ্ছে।
আফসানাঃ ম্যাম, আজাদও ঘুমোচ্ছে।
প্র: শিক্ষিকাঃ কী করবো বলো? ওরা তো রোজই ঘুমায়। আকাশ, আজাদ কী হচ্ছে? (চিৎকারে দু’জন চমকে ওঠে, ঘুম ভেঙ্গে যাবে) দুজনেই উঠে দাঁড়াও।
আকাশঃ ম্যাম, খুব খিদে পেয়েছে।
আজাদঃ আমারও খুব খিদে পেয়েছে।
প্র: শিক্ষিকাঃ তাই বুঝি? ইস! রে, বাছাদের খিদেয় ঘুম পেয়ে গেছে।
আকাশঃ সকালে আমাদের রান্না হয় না, ম্যাম। বাবা বাইরে কাজে গেছে। মা জলখাবার খেয়েই কাজে বেরিয়ে যায়।
আজাদঃ সকালে আমাদেরও রান্না হয় না, ম্যাম।
প্র: শিক্ষিকাঃ সে তো আমি জানি। ঠিক আছে। খিদের কষ্ট এখনই দূর হয়ে যাবে। স্কুলের রান্না হয়ে গেছে। আজ তোমাদের ডিম খাওয়াবো, পায়েশ খাওয়াবো।
আজাদ,আকাশঃ (খুশি) কী মজা! কী মজা! আজ আমরা ডিম খাবো, পায়েশ খাবো।
আশাঃ ম্যাম, আজ তো আমাদের লেখাপড়া কিছুই হলো না।
আফসানাঃ শুধু আজ কেন রে আশা, কোনোদিনই তো ভালোভাবে লেখাপড়া হয় না।
প্র: শিক্ষিকাঃ দেখ, বলছো বটে। আমি তো চেষ্টা করি। দু’জন মাত্র টিচার। যন্ত্রণায় আমিও বিদ্ধ হচ্ছি। আমি নিরুপায়, আর তোমাদের দুর্ভাগ্য। এ যে দুর্ভাগ্যপুরের দুর্ভাগ্য। শুধু কি তাই ? এমন দুর্ভাগ্য তো গোটা রাজ্য জুড়েই। এখানে আলো নিভে গেছে। এখানে হতভাগ্যরা শুধু দু’মুঠো খেতেই পায়। থাক্ এসব কথা। চলো সোনামণিরা,সবাই খেতে চলো।
(সকলের প্রস্থান)
২৫ শে বৈশাখ বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী উদযাপন। সকালের সূর্য উঠেছে পুব আকাশে। অনুষ্ঠান কক্ষের সামনে ফুল-মালায়, ধূপের ধোঁয়ায় সুশোভিত রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। তাঁর দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে এসে দাঁড়িয়ে শিশুরা, সাথে প্রধান শিক্ষিকা। শিশুদের অনেকের বাবা-মায়েরাও এসেছেন, বসে আছেন দর্শক-আসনে। বেজে চলেছে রবীন্দ্র সংগীত।
(সংগীত বন্ধ হয়। শুরু হয় কবির প্রতি শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন)
প্র: শিক্ষিকাঃ উপস্থিত সুধীবৃন্দ এবং আমার ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীরা। আজ ২৫ শে বৈশাখ, বিশ্ববরেণ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। প্রথমে আমরা তাঁর প্রতিকৃতিতে ফুল ও মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবো।
(সংগীতের সুর এবার ক্ষীণ হয়ে আসে। প্র:শিক্ষিকা মালা পড়ালেন প্রতিকৃতিতে। একে একে ছাত্রছাত্রীরাও এসে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করতে লাগলো। আকাশ ও আজাদের মায়েরাও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করলেন)
আকাশঃ (কৌতুহলবশতঃ) ম্যাম, রবীন্দ্রনাথ কে ছিলেন?
আজাদঃ (কৌতুহলবশতঃ) আমরা ওঁনার জন্মদিন পালন করি কেন?
( আরতির প্রবেশ)
আরতীঃ দিদিমণি, আমি আকাশের মা। সত্যিকারে বলতে কী, আমিও চিনি না, জানি না – এই মানুষটা কে ছিলেন। পাড়া-গায়ের মানুষ, পাড়াগায়েই বড় হয়েছি। লেখাপড়া জানি না, তাই চিনবো কী করে?
(সুফিয়ার প্রবেশ)
সুফিয়াঃ ম্যাডাম, আজাদ আমার ছেলে। লেখাপড়া করার সুযোগ আমারও হয়নি। খাটতে খাটতে বড় হয়েছি। আজও খেটে খাই। দেশ-দুনিয়ার খবর আমরা জানবো কী করে? এমন মানুষ আমাদের দেশে জন্মেছিল, সে কথা আমিও জানিনা।
প্র: শিক্ষিকাঃ হে আমার ভারতবর্ষ, দুর্ভাগ্যপুরের এমন দুর্দশা কেন, আমার জানা নেই। হে বিশ্ববরেণ্য কবি, জগৎসভায় তুমি এই দেশের নাম উজ্জ্বল করেছিলে, বাংলা ভাষাকে উচ্চাসনে বসিয়েছিলে, তবু এই দুর্ভাগ্যপুরের নীল আকাশের নিচে অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়নি।
আরতীঃ যে মানুষটা বাংলাদেশের নাম এত বড় করেছে, সেই বাংলায় আমার ছেলেটাও জন্মেছে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। বড়ই দুর্ভাগ্য! আজও ছেলেটা অক্ষর চেনেনা, নিজের নামটা লিখতে পারেনা, বাংলা বই পড়তে পারেনা। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে! (চোখে জল আসে )
সুফিয়াঃ আকাশের মা, তোমার-আমার, আর আমাদের ছেলেদের ভাগ্য এক সুরে গাঁথা। আমার আজাদ না খেয়ে স্কুলে আসে। খিদের জ্বালায় পড়তে ভালো লাগে না, ঘুমিয়ে পড়ে। খাবারটা পায় ঠিকই কিন্তু লেখাপড়া কিছুই শিখতে পারেনি। এ দুঃখ আমি যে আর সইতে পারি না। (চোখে জল আসে )
প্র: শিক্ষিকাঃ (আত্মগ্লানি, নালিশ অন্তর্যামীকে) ‘অন্ধজনে দেহ আলো’। সেই আলো আমি দিতে পারিনি। আমি অন্তর থেকে চেয়েছিলাম, তবু পারিনি, পারিনি দীপ জ্বালাতে। সবাই বলে – মানুষ গড়ার শিল্পী আমি। কাদামাটির ঢেলা দিয়ে শুধুই নিথর প্রতিমা গড়েছি, প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। মায়েরা, আর যারা আছো দুর্ভাগ্যপুরের মানুষ, যদি পারো,আমাকে ক্ষমা করে দিও। আজ তোমাদের অশ্রুজলেই অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়ে যাও এই মহামানবকে।
(নেপথ্যে সংগীতঃ আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, ……………. )