নাটিকা |
বনস্পতি | – হরবিলাস সরকার |
(নেপথ্যে)
বনলতার স্বপ্ন ছিল, সে তার চারপাশ সবুজে ভরিয়ে তুলবে। বনানীর স্নিগ্ধ-শীতল ছায়াতলে গড়ে তুলবে সুখের নীড়।
১ম দৃশ্য
(একটি গাছের চারা হাতে বনলতার প্রবেশ)
বনলতাঃ জানো, আমি আজ এখানে কেন এসেছি? সেকথা আমি নিশ্চয়ই বলব। চেয়ে দেখ, আমি এসেছি একটি ছোট্ট প্রাণ হাতে নিয়ে। ও এখন নিতান্তই শিশু। নীল আকাশের নিচে এই সুন্দর সবুজ আঙিনায় আমি ওকে মানুষ করব। ওকে বড় করে তুলব। ও এখন বড়ই অসহায়। কিন্তু আমি ওকে রক্ষা করব। আমি যে ওর দিদি ‘বনলতা’ । আর ওর নাম বনস্পতি। কী সুন্দর মিল আমাদের দু’জনের নামের মধ্যে! তাই না? আজ আমি বনস্পতিকে বসুন্ধরার কোলে তুলে দেব। বসুন্ধরা …. , বসুন্ধরা …….., কোথায় তুমি?
(মনুষ্য রূপে বসুন্ধরার প্রবেশ)
বসুন্ধরাঃ এইতো আমি বনলতা। বনস্পতিকে নিয়ে এসেছো! দাও, দাও, আমার কোলে দাও।
বনলতাঃ নাও বসুন্ধরা। সাবধানে নাও। ও যেন ব্যথা না পায়।
বসুন্ধরাঃ ব্যথা পাবে না বনলতা।
বনলতাঃ কিন্তু ও কাঁদছে কেন? আমি যে ওর কান্না শুনতে পাচ্ছি। ইস! কতই না ব্যথা পেয়েছে!
বসুন্ধরাঃ না বনলতা। ও খেতে চাইছে। আহা রে! ছোট্ট বনস্পতির না জানি কত খিদে পেয়েছে! কেঁদো না বনস্পতি। মালিনী এক্ষুনি আসবে, তোমার জন্য খাবার নিয়ে। (একটু থেমে) তুমি জল খাবে? ছোট্ট সোনামনির বুঝি পিপাসাও লেগেছে। জল চাইছে। ওর যে আর দেরি সইছে না। সোনা, বুঝি আমি, তোমার কষ্ট। আমি যে তোমার মা।
বনলতাঃ বসুন্ধরা, তুমি চিন্তা করো না। আমি গিয়ে দেখি, মালিনীর খাবার তৈরি করা হলো কিনা। (কিছুটা এগিয়ে) মালিনী …., মালিনী ……..।
মালিনীঃ আসছি আমি, বনলতা।
(মালিনীর প্রবেশ)
মালিনীঃ এইতো আমি এসে গেছি, বনলতা, খুকুমণির খাবার আর জল নিয়ে।
বসুন্ধরাঃ দাও, দাও, মালিনী! আমার বনস্পতিকে জল আর খাবার দাও।
মালিনীঃ (খাবার দেবে) খুকুমণি, খাবারটা খেয়ে নাও। বাঃ খুকু আমার কত ভালো! খাবারটা খেয়ে নিল। এবার জলটা খেয়ে নাও। (জল দেবে) আস্তে আস্তে খাও।
বসুন্ধরাঃ সোনামণি আমার রোদে কষ্ট পাচ্ছে। যাও মালিনী, ছাতাটা নিয়ে এসো।
মালিনীঃ হ্যাঁ বসুন্ধরা, আমি যাচ্ছি ছাতা আনতে। (চলে যেতে উদ্যত)
বনলতাঃ মালিনী, তোমাকে ছাতা আনতে হবে না। ছাতাটা আমি নিয়ে আসছি। তুমি বরং চাদরটা নিয়ে এসো। বনস্পতির বিছানা তৈরি করতে হবে। বাছা আমাদের ঘুমোবে।
মালিনীঃ ঠিক আছে বনলতা। আমি যাচ্ছি চাদর আনতে। (প্রস্থান)
(বনলতা ছুটে গিয়ে ছাতা নিয়ে এলো।)
বসুন্ধরাঃ ছাতাটা তাড়াতাড়ি খোলো, বনলতা। বনস্পতির মাথার উপরে ধরো। দেখবে, ও খিলখিল করে হেসে উঠবে।
বনলতাঃ (ছাতাটা খুলে বনস্পতির মাথার উপরে ধরবে) হ্যাঁ বসুন্ধরা, সত্যিই ও খিলখিল করে হাসছে। আর দেখ, মাথা নেড়ে নেড়ে যেন বলতে চাইছে, দিদি,তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না। আমি যখন বড় হবো, তোমাদের সবাইকে ঝড়, বন্যা, প্রখর রোদ থেকে রক্ষা করবো। সবাইকে ছায়া দেবো। প্রাণবায়ু অক্সিজেন দেবো। পাখিরা আমার শাখায় শাখায় বসে গান গাইবে। নির্মল হবে প্রকৃতি। মেঘমালা আসবে ছুটে। আকাশ হতে বর্ষিত হবে বারিধারা। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হবে মা বসুন্ধরা।
বসুন্ধরাঃ হ্যাঁ বাছা, তোমার কথা সত্যি হোক, আমি আশীর্বাদ করছি। তবে এখন তোমার বিশ্রামের সময়, ঘুমানোর সময়।
(চাদর হাতে মালিনীর প্রবেশ)
মালিনীঃ হ্যাঁ গো বসুন্ধরা, চাদরটা পেতে দিচ্ছি। বাছা বেশ আরামেই ঘুমোবে।
(চাদর পেতে দেবে)
বনলতাঃ ঘুমোও বনস্পতি।
মালিনীঃ ঘুমোও সোনামণি, ঘুমোও।
বসুন্ধরাঃ (ছড়া বলে ঘুম পারাবে)
“খোকন ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কীসে?
ধান ফুরালো, পান ফুরালো, খাজনার উপায় কী?
আর ক’টা দিন সবুর করো, রসুন বুনেছি।”
বনলতাঃ বসুন্ধরা, মালিনী, খুকু ঘুমিয়ে পড়েছে। চলো, আমরা এখন আমাদের কাজগুলো সেরে নিই।
বসুন্ধরাঃ হ্যাঁ বনলতা, চলো।
মালিনীঃ ঘুমোও খুকু। শান্তিতে ঘুমোও। ঘুম থেকে উঠে আবার খাবার খাবে, জল খাবে।
বনলতাঃ মালিনী, আজ থেকে বনস্পতির পরিচর্যার দায়িত্ব তোমার।
মালিনীঃ এ তো আমার সৌভাগ্য, বনলতা।
(বনলতা,বসুন্ধরা,মালিনীর প্রস্থান)
২য় দৃশ্য
(নেপথ্যে ভাষ্য)
অনেক বছর পর। বনস্পতি বড় হয়েছে। সে ডালপালা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে।
বসুন্ধরাঃ এসো বনলতা, মালিনী। দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে! সেই ছোট্টটি ছিলে, আজ মাথার চুলে পাক ধরেছে। চেয়ে দেখো, বনস্পতি আমাদের আকাশ জুড়ে কেমন সুন্দর ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে! কত বছর ধরে ও আমার কোলে মানুষ হয়েছে। আজ কলেবরে কত বড় হয়েছে!
বনলতাঃ ওর শাখায় শাখায় হলদে-লাল ফল ধরেছে।
মালিনীঃ মৌমাছির গুঞ্জনে ভরে উঠেছে চারদিক। শীতল ছায়ায় এসো আমরা প্রাণ জুড়িয়ে নিই।
বনলতাঃ বনস্পতি, তুমি কি কিছু বলবে? বলো বনস্পতি। তুমি আমাদের হৃদয়। কেউ না বুঝলেও আমরা তোমার কথা বুঝতে পারি।
বনস্পতিঃ (নেপথ্য কন্ঠে ভাষ্য) জননীগো, বনলতা দিদি, মালিনী, তোমাদের স্নেহ-মমতা-ভালবাসায় আমি বড় হয়েছি। তোমাদের সকলকে শতকোটি প্রণাম। তোমাদের বয়স বেড়েছে। আজ যে আমার প্রতিদান দেবার পালা। শান্তির এই স্নিগ্ধ-ছায়াতলে বসে তোমরা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নাও। ক্লান্ত পথিক যত, সকলকে আমন্ত্রণ জানাও। আনন্দে ভরিয়ে তোলো সারা পৃথিবী।
বনলতাঃ সত্যিই আজ আমাদের আনন্দের দিন। জলে-স্থলে, আকাশে-বাতাসে যত বিষ, তা গ্রহণ করে তুমি উপহার দিয়েছো সুন্দর এই সবুজ অরণ্য। আমরা তোমার অকৃপণ দান কোনদিন ভুলবো না।
বনস্পতিঃ (নেপথ্য কন্ঠে ভাষ্য) এ আমার জীবনের ধর্ম, কৃতজ্ঞতা আর অঙ্গীকার।
বসুন্ধরাঃ বনলতা, মালিনী, আজ আমার হৃদয়-বীণার তারে উঠেছে ঝংকার।
মালিনীঃ তবে এসো, হাতে হাত ধরো। আকাশ, বাতাস মুখরিত হোক সুরে সুরে।
“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায় !………………।”
বনস্পতিঃ (নেপথ্য কন্ঠে ভাষ্য) মা জননী, এত আনন্দের মধ্যেও আমি যে শুনতে পাই বিষাদের সুর।
বসুন্ধরাঃ কেন বনস্পতি?
বনস্পতিঃ (নেপথ্য কন্ঠে ভাষ্য) পৃথিবীতে এখন রাত নেমে এলেই আমার ভয় হয়। মৃত্যুভয়। স্বার্থান্বেষী হৃদয়হীন মানুষেরা আমাকে নিধন করে নিজেদের আখের গুছাতে চায়। বোঝেনা, আমাদের বাঁচিয়ে না রাখলে কেউ বাঁচবে না। পৃথিবী মহাশ্মশানে পরিণত হবে।
বনলতাঃ এ তুমি কী শোনালে, বনস্পতি?
বনস্পতিঃ (নেপথ্য কন্ঠে ভাষ্য) দিদি গো, মাগো, ভয় পেয়ো না। রাত হয়েছে, যাও। তোমরা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
বসুন্ধরাঃ যাচ্ছি বাছা। মায়ের পরান তো, দুর্ভাবনা হয়।
মালিনীঃ ভালো থেকো বনস্পতি, ভালো থেকো।
(চোখের জলে বনলতা, বসুন্ধরা, মালিনীর প্রস্থান)
(নেপথ্যে ভাষ্য)
রাত বাড়তে থাকে। নিশুতি প্রহরে এক ভাড়াটে দুর্বৃত্ত তার অনুগতদের নিয়ে এলো বনের মধ্যে। সবার কাঁধে ধারালো কুঠার।
দুর্বৃত্তঃ হাঁ হাঁ হাঁ ………, এতক্ষণে মধ্য রাত পেরিয়ে গেছে। এখন আর কেউ জেগে নেই। লোকে আমাদের দুর্বৃত্ত বলে। বলুক। ওতে কিছু যায় আসে না। সবার আগে কাটবো বিশাল এই বটগাছটাকে। গাছগুলো কেটে সরিয়ে ফেলতে পারলেই মালিক এই ফাঁকা জমিতে ঝকমকে নগরী বানাবে। সেখানে থাকবে আকাশ-ছোঁয়া চকচকে বাড়ি, বাহারি লেক, পার্ক কতকিছু! আর আমার হাতে আসবে অনেক, অনেক টাকা। গাড়ি, বাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, কত কিছু হাতের মুঠোয়। তারপর যদি একবার ভোটে দাঁড়িয়ে জিততে পারি, আমি হব প্রভাবশালী মন্ত্রী।
দুর্বৃত্ত-অনুগতগণঃ বস্, হুকুম দিন।
দুর্বৃত্তঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ, কুঠার চালা।
(গাছ কাটতে থাকবে।)
দুর্বৃত্ত-অনুগতগণঃ মারো কোপ জোরসে। কাটো গাছ জোরসে। (৩ বার)
বনস্পতিঃ নেপথ্য কন্ঠে ভাষ্য) আমাকে কেটো না। কী অসহ্য যন্ত্রণা ! সইতে পারছি না। আমি মরে যাবো। মরে গেলে তোমরাও যে বাঁচবে না। হে অবুঝের দল, মনে রেখো, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
(সব গাছ কাটা হয়ে গেলে টানতে টানতে নিয়ে যাবে।)
বনস্পতিঃ (নেপথ্য করুণ কন্ঠে ভাষ্য) মাগো, দিদিগো, বাংলার মানুষ সকল, তোমরা ভালো থেকো। রাত পোহাতে আর বেশি দেরি নেই। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবস। বিদায় বেলায় তবু গেয়ে যাই, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’
দুর্বৃত্ত-অনুগতগণঃ মারো টান, হেঁইও। জোরসে টানো, হেঁইও। (৩ বার) (প্রস্থান)
(নেপথ্যে ভাষ্য)
রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠল যখন, মালিনী উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এল সবুজ আঙিনায়।
মালিনীঃ এ আমি কী দেখছি! কোথায় আমাদের বনস্পতি? বনলতা….., বসুন্ধরা……., এসে দেখ, আমাদের বনস্পতি আর নেই।
(ছুটে এল বনলতা, বসুন্ধরা।)
বনলতাঃ বনস্পতি ….., বনস্পতি …….., কোথায় তুমি? (কান্নায় ভেঙে পড়বে)
বসুন্ধরাঃ খুকু….., খুকু…….। এই তো ওর পায়ের চিহ্ন। ঘাতকের হাতে বলি হয়েছে। তবে কি খুকু আমার চিরতরে হারিয়ে গেল? (আকুল হয়ে কাঁদবে )
(নেপথ্যে আবেগপ্রবণ ভাষ্য)
এমনিকরেই তিল তিল করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সবুজ অরণ্য। প্রকৃতি বড়ই অসহায়। হে ঈশ্বর, তোমার সৃষ্ট ‘প্রকৃতি’র জল, স্থল, আকাশ, বাতাস যারা বিষে পরিপূর্ণ করে তুলেছে, তারা সভ্যতার শত্রু, অবুঝ, হৃদয়হীন। তাদের বিবেক জাগ্রত কর।
সমাপ্ত