– হরবিলাস সরকার
: শুরুর কথা :
দিনের শুরু ভোর । জীবনের
শুরু সেও–তো ভোর । ভোরের সূর্য যখন পূর্ব আকাশে দিগন্তের
ওপারে, তাঁর আলোর
রেখায় সূচনা হয় নতুন দিনের । জীবনের আকাশেও ভোরের সূর্য ওঠে, তাঁর আলোয় বিকশিত হয় নবজাতকেরা। সেই সূর্য আর কেউ নয়, সে এক মহান হৃদয়ের অধিকারী, সে ভোরের পাখি। ঘুমন্ত শিশুর চোখের ঘুম ভাঙায় সে, বলে – “জাগো, ওঠো, বই নিয়ে বসো, তোমার হৃদয় মন্দিরে প্রদীপ জ্বালো, অন্ধকার দূর হয়ে যাবে ।” সে শপথের বাণী পাঠ করায় – “
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি । আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে, আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে ।” সে প্রেরণা যোগায় – “আমাদের
দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে । মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে এই
তার পণ ।” সে সাদা সেলেটে বর্ণের পর বর্ণ এঁকে ভরিয়ে তোলে, শব্দের পর শব্দ বসিয়ে অমৃত কথার মালা গাঁথে । সে মানবতার
মন্ত্র শেখায়, সে
মনুষ্যত্বের বীজ বপন করে – “সকলে আমরা সকলের তরে, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে ।” সে পিতাকে চিনতে শেখায় – “পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি
পরমং তপ। পিতোরি প্রিতিমা পন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতাঃ।। ” সে মাতৃভক্তি শেখায় –
কেমন করে দুর্যোগময় রাতেও সন্তান তার মায়ের ডাকে একাকী স্রোতস্বিনী বিপদসংকুল
দামোদর পেরিয়ে আসে । সে এক মহান শিক্ষক । মৃৎশিল্পী যেমন নরম মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে,
তেমনি শিক্ষক কচি চারাগুলোকে সযত্নে ভোরের আলোকের ঝর্ণাধারায় বড় করে তোলে ।
তাইতো সে মানুষ গড়ার কারিগর ।
: প্রারম্ভ শিক্ষার সেকাল আর একাল :
সে আমার শিশু বেলার কথা ।
স্মৃতির সেই পাতাগুলো আজও কখনও কখনও চোখের সামনে একে একে ভেসে ওঠে । গ্রামে গ্রামে
তখনও বিদ্যুতের আলো জ্বলে ওঠেনি । শিশু-শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি । গ্রামের মাঝে
পাঠশালা বসতো উন্মুক্ত গাছতলায় । ছিলেন একজন মাস্টারমশাই, একজন দিদিমণি । সেখানে দলেদলে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে
আসতো । সেখানেই আমার হাতে খড়ি হয়েছিল । পাথরের স্লেট ছিল । তবে আমরা
তালপাতায় লিখতাম বাঁশের কঞ্চির কলম দিয়ে
। কালি বলতে অঙ্গারের কালি । আখা থেকে নিভন্ত অঙ্গার তুলে গুড়ো করতাম, তারপর
দোয়াতে ভরে জল মিশিয়ে কালি তৈরি করে নিতাম। কখনো বাবা,
কখনো মা–ও তৈরি করে দিত । তালপাতায় বর্ণ, যুক্তবর্ণ খোদাই করে দিতেন মাস্টারমশাই অর্থাৎ আমাদের
প্রিয় স্যার । প্রথমে বেশ কিছুদিন আমরা
খোদাই করা তালপাতায় হাত বুলাতাম, তারপর ধীরে ধীরে খোদাই না করা তালপাতায় লিখতে শুরু করতাম ।
দুই হাত,
দুই পা, জামা প্যান্ট, বসার আসন কালিতে ভরে যেত । সেই কালো কালি যে ছিল জীবনের আলো
তা অবুঝ মনে সেদিন হয়তো বুঝতে পারতাম না ঠিকই, তবে দিদিমণি, স্যারের স্নিগ্ধ শীতল দুই হাতের স্পর্শ কেমন যেন আপন করে
নিতো তা বুঝতে পারতাম । লিখতে না পারলে
তাঁরা কোলের মধ্যে বসিয়ে হাতে ধরে
লেখাতেন। মনে হতো আমরা মায়ের কোলে
বসে লিখছি ।
লেখার পরে শুরু হতো পড়ার পালা
। “লীড ফলো ” আকারে পড়ানো হতো । পালা করে এক এক জন প্রথমে বলতো, শুনে শুনে অন্যরা বলতো । আর তাতে থাকতো ছন্দ, সুর আর ঝংকার ।
মজা আর আনন্দে পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠতো। মাঝে থাকতো প্রায় এক
ঘন্টার টিফিন । সে সময় আমরা দলবেঁধে খেলতাম । স্যার দিদিমণিরাও আমাদের সাথে
খেলতেন । নতুন নতুন খেলা শেখাতেন । গোল করে বসিয়ে গল্প বলতেন । মনীষীদের কথা
বলতেন; গান, আবৃত্তি শেখাতেন । মা-বাবা গুরুজনদের প্রতি কেমন ব্যবহার করতে হয় বলতেন ।
শীতের মরশুমে আমাদের অনেকেরই
বাড়িতে গাছে কুল ধরত । তবে নারকেল-কুলের
গাছ সবার ছিল না। আমাদের বাড়ির উত্তর সীমায় একটা বড় নারকেল–কুল গাছ ছিল । ধরতও প্রচুর, যেমন বড় তেমনি মিষ্টি । পাকলে লাল হয়ে যেত । মা সেই কুল
পেরে বেতের ধামায় ভরে আমাকে দিতেন । আমি
তা পাঠশালায় নিয়ে এসে সবাইকে দিতাম ।
চৈত্র-বৈশাখ মাসে গাছে গাছে আম
ধরত । আমরা পকেটে ভরে কাঁচা আম নিয়ে আসতাম । স্যার, দিদিমণিকে দিতাম । দিদিমণিও আমাদের আম মাখানি করে খাওয়াতেন । আম পাকলে আরও মজা করে খাওয়া
হতো । একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল । পাঠশালায় আসার পথে গাছে ঢিল মেরে কটা পাকা আম পেড়ে এনেছিলাম ।
সঙ্গে সঙ্গে নালিশও এল শমন হয়ে । স্যার
(রাধিকা স্যার) আমার বাঁ গালে সপাটে একটা
চড় মারলেন । আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম । কী মনে হলো জানিনা, স্যার আমাকে বুকে তুলে নিলেন । আমার চোখের জল মুছতে মুছতে
বললেন,
“সোনা, খুব লেগেছে, তাই না? ” ইস! গালটা লাল হয়ে গেছে। কিন্তু লোকে যে তোমাকে খারাপ বলবে
। পরের জিনিস না বলে নিতে নেই । আর কোনদিন এরকম করোনা ।…….. ।” আমার কান্না
থেমে গিয়েছিল । পরদিন স্যার তাঁর
গাছ থেকে পাকা আম পেড়ে এনে আমাদের সকলকে খাওয়ালেন । তারপর থেকে আর কখনো পরের
গাছে ঢিল মারিনি ।
এভাবে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত
করে ভর্তি হলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । বেশ কিছুটা দূরে মেঠো পথ ধরে
হেঁটে যেতে হতো । মাথার উপরে ছিল টিনের চাল, চারপাশে গাছের খুঁটি আর খলপার বেড়া । সেই বিদ্যালয়ে পেলাম চারজন স্যার আর দুজন দিদিমণিকে
। পড়াশোনার পরিবেশ সেই পাঠশালার মতই । সেই আন্তরিকতা আর স্নেহের পরশ । তবে দোষের
ক্ষমা ছিলনা, পড়াশুনায় ফাঁকির পথ
একেবারেই বন্ধ ছিল । হেডস্যার অংক শেখাতেন ।
আমার এক কাকা ইংরেজি পড়াতেন । এই দুজন ছিলেন অত্যন্ত কঠিন আবার কোমলও ।
অংক বা পড়ায় না পারা পর্যন্ত শেষ ঘন্টা বেজে
গেলেও ছুটি হতো না । হেড স্যারের
বাড়ি ছিল দূরের কোন এক গ্রামে, থাকতেন স্কুলের কাছাকাছি এক বাড়িতে । নিয়মিত সন্ধ্যার পর
তিনি এবং অন্যরাও বাড়ি বাড়ি ঘুরে লক্ষ রাখতেন
কোন ছাত্র বা ছাত্রী তখনও বই নিয়ে পড়তে বসেছে কিনা । হেডস্যার বলতেন – ঘুম পেলে অংক নিয়ে বসবে, দেখবে ঘুম চলে যাবে ।
বাংলা দিদিমনি খুব সুন্দর করে
বাংলা পড়াতেন । আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম । খুব
সুন্দর আবৃত্তি করতে পারতেন । যেদিন রচনা পড়া থাকতো – আমাদের না দেখে লিখতে বলতেন । কিন্তু না, মুখস্থ লেখা চলবে না, কী জেনেছি তা নিজের ভাষায় লিখতে হবে, এখানে তিনিও ছিলেন কঠোর ।
ইতিহাস স্যারও মুখস্থবিদ্যা পছন্দ
করতেন না। অর্থাৎ গোটা বিষয়টা পড়ে কী জেনেছো তা নিজের মত করে নিজস্ব শব্দচয়নে
বুঝিয়ে বল । আমাদের বিজ্ঞান শেখাটা ছিল একটা মজাদার ব্যাপার । স্যার প্রায়ই কীসব জিনিস , যন্ত্রপাতি নিয়ে আসতেন, বিভিন্ন গাছ লতাপাতা ফুল–ফল নিয়ে আসতেন । সবকিছু হাতে-কলমে শেখাতেন।
আমরা ক্লাসে হইচই করতাম না ।
আসলে পড়াশুনার প্রতি আমাদের এত আগ্রহ
জেগে উঠত যে আমরা তারই নেশায় মেতে থাকতাম ।
আর ছিল কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা । হেডস্যার ঘুরে ঘুরে আড়াল থেকে সবকিছু নজর
রাখতেন । তবে ‘ভক্ত’ নামে একটা উশৃংখল ছেলে ছিল । তখন আমরা চতুর্থ শ্রেণীতে
পড়ি । একদিন হেডস্যার ক্লাসে অংক করাতে এসে কিছুতেই ভক্তকে অংক শেখাতে পারছেন না
। ভক্তও শিখতে চাইছে না । পাঁচবার
বোঝানোর পরও ফল হলো না । স্যার ভীষণ রেগে
গেলেন আর ভক্তকে পিঠে একের পর এক লাঠির
বাড়ি মারলেন । ভক্ত কাঁদলো না, বরং হাসলো । এই দৃশ্য দেখে স্যারের মুখখানা কালো হয়ে গেল । স্যার কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে
থেকে পুনরায় ভক্তের কাছে এলেন । পিঠে হাত
বুলিয়ে দিয়ে মজা করে বললেন, “ভক্ত বড় শক্ত, পিটান খায় পাঁচশো। ” আমরা
সবাই হেসে উঠলাম । স্যার আমাদের ধমক দিলেন । ভক্ত তখন লজ্জিত হলো । পরবর্তী
জীবনে সেই ভক্তই এক কলেজে গণিতের শিক্ষক হয়েছে ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের
আরো কতগুলি বিষয় শেখানো হতো । সপ্তাহে একদিন
মধ্যাহ্নের পর আমাদের খেলার মাঠে নেমে পড়তে হতো । আমরা হাডুডু, ফুটবল খেলতাম । মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দৌড়াতাম ।
এসব খেলায় স্যারেরাও অংশ নিত । প্রতি শনিবার একটি নান্দনিক ক্লাস হত । সেখানে
আবৃত্তি, গান,
বক্তৃতা করা শেখানো
হতো । এছাড়া বিশেষ বিশেষ দিনে মনীষীদের
জীবন চর্চা করা হতো ।
সে সময় পরিবারের একটা বড়
ভূমিকা ছিল । আমরা টিউশন পড়তাম না, দরকারও ছিল না ।
সন্ধ্যার পর মা বসতেন আমাদের ভাই–বোনদের নিয়ে । রাতে বাবা বসতেন
অংক আর হাতের লেখা নিয়ে । মা-বাবা প্রেরণা যোগাতেন । ছড়া বলাতেন, “মহাজ্ঞানী, মহাজন যে পথে করেছেন গমন, হয়েছেন
চিরস্মরণীয়, সেই পথ
লক্ষ্য করে, স্বীয়
কীর্তি–ধ্বজা ধরে আমরাও হব বরণীয় ।” ছড়াটা মুখস্ত হয়ে গেলে প্রায় প্রতিদিনই
একবার করে মুখে আওড়াতাম। বাবা গল্প বলতেন
বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সম্বন্ধে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে । অনুপ্রাণিত হতাম – কীভাবে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মে
মেঘনাদ পরবর্তী জীবনে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েছিলেন । মা বলতেন – “জীবনে বড় হতে
হবে” । এই বড় মানে বড় চাকুরী নয়, বড় মানুষ হবার কথা বলতেন । স্মৃতির সেই
পাতাগুলো আজ শুধু উল্টে উল্টে দেখি।
গুঞ্জুরিয়া ওঠে মন – “কী সুন্দর দিন
কাটাইতাম আমরা, কী সুন্দর দিন কাটাইতাম,” “পুরানো সেই দিনের কথা সে কি ভোলা যায়!”
এবার আসি একালের কথায় । দিন, পরিবেশ অনেক বদ্লেছে । আজ আমিও একজন প্রাথমিক শিক্ষক । বর্তমানে একটি সরকারি বিদ্যালয়ের
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক । কিন্তু
শিশুবেলার দিনগুলোতে বিদ্যালয় থেকে যা পেয়েছি ,বিনিময়ে আজ তা থেকে
কিছুটাও নতুন প্রজন্মকে দিতে পারিনা । ইচ্ছাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় । ফলে
উদাসীনতা এসে বাসা বেঁধেছে হৃদয়–আঙিনায়।
আজগুবি,অবাস্তব
গল্প–কাহিনীতে ভরা বইপত্র গুলো। নীতিকথা, উপদেশ ,চরিত্রগঠনের প্রাথমিক উপাদানগুলি বর্জিত হয়েছে। সিলেবাস শিশু উপযোগী হয়ে ওঠেনি। সংস্কার সাধন অত্যন্ত জরুরী।
শিক্ষকেরা বিদ্যালয় বহির্ভূত নানারকম কাজকর্মে ব্যতিব্যস্ত, যেমন – ভোটার তালিকায় নাম তোলা, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চাইল্ড রেজিস্টার পূরণ করা, সেন্সাস, ভোট নিতে যাওয়া এসব বাধ্যতামূলক । এছাড়া বিদ্যালয়ে হাজার
রকম করণিকের কাজ শিক্ষকদের করতে হয় । তারপর
থাকে আজ এ মিটিং কাল সে মিটিং । মিড ডে মিলের অনেকগুলো খাতা মেন্টেন
করতে হয়। । প্রতিদিন মিড ডে মিলের তদারকি ,খাবারের মান পরীক্ষা ,কত ছাত্র মিড-ডে-মিল খেল সেই হিসাব প্রতিদিন ব্লক অফিসে মোবাইল ফোন মাধ্যমে
পোস্ট করতে হয়। এছাড়া এস.আই, সংসদ অফিসে মাঝেমধ্যেই শিক্ষকদের যাতায়াত করতে হয় নানা
প্রয়োজনে।
আমি যখন প্রথম সহকারি শিক্ষক
হিসেবে যোগদান করি শত কাজের মধ্যেও
ছেলেমেয়েদের পঠন-পাঠনে জোর দিই , অন্যান্য সহকারীদেরও এ বিষয়ে ইতিবাচক হতে বলি, তখনকার যিনি হেড টিচার ছিলেন (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত )একদিন
আমাকে বললেন – “মাস্টারমশাই, অত খেটে লাভ নেই । আমাদের কাজ হল – শুধু রান্না করা আর
খাওয়ানো,
আর মাস গেলে মাইনেটা পাওয়া । চাকুরী করতে এসেছি, চাকরী
ফুরালে চলে যাব।” সেদিন আমি হতবাক
হয়েছিলাম । মনে মনে বলেছিলাম – সমাজ
তাহলে শিক্ষকদের এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে! শিক্ষাদান আজ আর ব্রত নয়, চাকুরী হয়েছে। তাহলে কেন আজও আমরা শিক্ষক দিবস পালন করি? শুধু থাকবে বাইরের আড়ম্বর,ভেতরে যা কিছু – সবই অন্তঃসারশূন্য ?
এর ঠিক কদিন বাদে বাসে
করে স্কুলে যাচ্ছিলাম । প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান নিয়ে আলোচনা চলছিল। পাশের একজন বয়স্ক চাষি গোছের লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন – “কীসের চাকরি করেন ভাই ?”একটু অস্বস্তিতে পড়লাম -কী উত্তর দেব ? একটু আগে আলোচনার মাঝেই একজন শিক্ষকের সংগে এক ভদ্রলোকের ‘সীটে বসা’ নিয়ে বেশ
খানিকটা তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ভদ্রলোকই উত্তরটা হঠাৎ
করে বলে দিলেন ছড়ার আকারে , “ আসি
যাই,
মাইনে পাই , সেই স্কুলের মাস্টার ভাই ।” চাষি লোকটি তৎক্ষণাৎ বুঝে নিয়ে বলল -প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি
করেন ভাই? আমি নীরবে শুধু মাথাটা ঝাঁকালাম।
লজ্জাবোধ হতো আমার, আর এ কারণেই আমি বহুবার চেষ্টা করেছি বিদ্যালয়ের শিক্ষার
পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে । কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি বারবার । ক্ষতিকারক রাজনৈতিক আবেশ
শিশুদের শিক্ষাঙ্গন আবিষ্ট না করলেই মঙ্গল হয়।
কিছু সুবিধা ভোগের বিনিময়ে কারও
অনুগত হয়ে থাকা – এই প্রক্রিয়ায়
শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে । অবাধ ফাঁকির রাস্তা তৈরি হয়েছে । স্কুলে দেরি করে আসা, যখন খুশি চলে যাওয়া , এ এক ব্যাক্তি স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা সৃষ্টি হয়েছে। শ্রেণীতে ছেলেমেয়েরা চিৎকার
চেঁচামেচি করছে, মারামারি করছে ,পাশে
টিচার্স রুমেও সমান্তরালে চলছে পারিবারিক নানা গল্প,তাতে কখনও আভিজাত্যের বর্ণনার উচ্ছ্বাস । এ ধারা হঠাৎ করে
গড়ে উঠেছে তেমন নয়। এ কত বছরের ,কত পুরানো পরম্পরা তার হিসেব নেই। কচিকচি ছেলেমেয়েরা
বই-খাতা হাতে স্কুলে আসে, বেশিরভাগই গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে, ওদের দেখে দুঃখ হয় । প্রথম শিক্ষার আলোটুকু থেকেই ওরা বঞ্চিত, তারপর আর বিকশিত
হতে পারেনা। শেষে একদিন নাম লেখায় শিশু শ্রমিকের খাতায় ।
একবিংশ শতকের উন্নত
প্রযুক্তির যুগে বিজ্ঞান উপহার দিয়েছে আমাদের সবার হাতে দামি মোবাইল ফোন । কিন্তু
আমরা বিজ্ঞানের আশীর্বাদকে গ্রহন না করে তার অপব্যবহার করছি। আমাদের রুচিবোধ, মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব আজ উপরে ওঠার বদলে তলদেশে নেমে এসেছে। অল্পবয়সী শিক্ষক -শিক্ষিকা হয়ে যারা আসছেন
তাদের বেশিরভাগই আজ অপসংস্কৃতির শিকার । শ্রেণীতে বসে অবিরত মোবাইলের বোতাম টেপা, দূরের বন্ধু , বান্ধবীর সাথে
দীর্ঘ সময় ধরে আবেগপ্রবণ কথোপকথন, সামনের
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তা দেখছে, শুনছে কৌতূহলে । ফলে ঘন কুয়াশার আবরণ ঘিরে দিয়েছে আজ
শিক্ষাঙ্গন । ভোরের
আলো তার ভেতরে পৌঁছাতে পারেনা ।
আরও ভয়ঙ্কর দিক হলো –
কাটমানির কালো ছায়া এসে পড়ছে
শিক্ষাঙ্গনেও । আপনা থেকেই চক্রব্যূহ তৈরি হয়ে যায়। সেই চক্রব্যূহে ঢুকতে হবে, আবার বেরোতেও হবে। বেরোনোর মন্ত্রটা শুধু শিখতে হয়। তা হল ‘মাসোহারা‘ মন্ত্র । ফলে
বিদ্যালয় – প্রধানের চৌর্যবৃত্তির শিকার হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কেউ যদি পেছন
থেকে “মাস্টার চোর” বলে ব্যঙ্গোক্তি ছুঁড়ে দেয়, নীরবে সইতে হয় ।
নমস্য শিক্ষকের সম্মানের
জায়গাটা আজ এখানে এসে
দাঁড়িয়েছে। তার জন্য দায়ী সমাজের তৈরি ব্যবস্থা ।
এছাড়া আছে দয়া-ভিক্ষার
ব্যবস্থা । দয়া-ভিক্ষার মধ্যে প্রভু –ভৃত্যের এক অদৃশ্য
সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মানুষকে যদি ‘কাজ‘ দিয়ে সক্ষম করে তোলা যায় তবে তারা
শ্রমের বিনিময়ে কিছু উপার্জন করবে, সেখানে
থাকবে গৌরবের, মর্যাদার
প্রশ্ন । মেরুদন্ডহীন,লোভী
জাতির মধ্যে দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেমের কোনো
চিহ্ন বা লক্ষণ গড়ে ওঠেনা । শুধু দয়া-ভিক্ষা যারা দেয় তাদের প্রভুত্ত কায়েমে
বড় সুবিধা হয়। মিড–ডে–মিল বিতরণ, সাইকেল বিতরণ, স্কলারশিপের টাকা বিতরণ, পোশাক বিলি, জুতো-মোজা বিলি, থালা-গ্লাস বিলি এর ফলে একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিপুল
লোভের সঞ্চার হয়েছে। তারা আজ
ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করে কাল ইটভাটায়, চায়ের দোকানে বা
বিড়ি বাঁধার কাজে পাঠিয়ে দিচ্ছে । এদিক-ওদিক দুদিক থেকেই ঘরে আসছে।
দারিদ্র ,বেকারত্ব এই মখনুষগুলোকে ভাবতে শিখিয়েছে-লেখাপড়া নাইবা হল, একবেলাতো পেট ভরে খেতে পাবে। এই আবহে পড়ে
আজ শিক্ষককুলও ভুলে গেছে যে, তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগর ।
তবুও সব শেষ হয়ে যায় না
। টেথিস মজে গেলেও সে রেখে গেছে স্মৃতিচিহ্ন
তাঁর উন্নত শির ‘হিমালয়‘ ।
সূর্য না থাকলেও অমাবস্যার আঁধারে জোনাকিরা আলো দেয় । সমাজে চিরকালই কিছু ভালো মানুষ থাকে, থাকে মহান মনীষী , আদর্শ শিক্ষক ।
নাহলে সভ্যতার আলো কে বা কারা জ্বালত ? একদিন ‘সেকাল‘ আবার
ফিরে আসবে কালের পরিবর্তনে নতুন হয়ে।
হয়তো সেই মহাজাগরণের দিনের অপেক্ষায় বন্ধুর পথে এগিয়ে চলতে হবে এখনো
অনেক দূর আপনার কর্ম, অধ্যাবসায় আর কঠোর ব্রত পালনের অঙ্গীকার করে
। বন্ধ্যা জননী আবার ফুলে-ফলে পরিপূর্ণ হয়ে ভরে উঠবে । যত আগাছা, অপকারী কীটেরাও লুপ্ত হয়ে যাবে নতুন ভোরের দীপ্ত শিখায় ।
* মরুবুকে বাগিচায় আজও ফোটে ফুল *
সোনার বাংলা আজ আর নেই । জীবন
এখানে মরুভূমির মতোই । তবু চেয়ে দেখো, কোথাও জলের সিক্ত
ধারা আছে । সেখানে তৈরি হয়েছে বাগিচা । ছোট ছোট চারা গাছেরা উচ্ছ্বাসে মাথা
দোলায়, গায়
জীবনের জয়গান । ‘বিবেকানন্দ
বিদ্যাবিকাশ পরিষদ’ পরিচালিত
সরস্বতী শিশু মন্দিরগুলি সেই বাগিচা । বিদ্যালয় নয়, মন্দির, মন্দিরে অধিষ্ঠান
হয় দেবতার । সেই মন্দিরের মুক্ত আঙিনায় প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসে ফুলের কুঁড়িরা যখন দুলতে থাকে তখন
তা শুধুই মন্দির নয়, বাগিচাও । তার মালিরা শিক্ষক-শিক্ষিকা
নন,
নতুন ভোরের রূপকার ‘আচার্য’, ‘আচার্যা’,
আরও সহজ ভাষায় ‘দাদাভাই’, ‘দিদিভাই’ । মনে হয় যেন অনেক
কাছের,
একান্ত প্রিয়জন ।
আমার আজও পুরানো দিনগুলোর
কথা মনে পড়ে । কোমল কন্ঠে সেই আদরের ডাকটুকু
অনুরণিত হয় । হাতজোড় করে বলা –‘ দাদা ভাই ,কেমন আছো?’ আর এখন
রাস্তায় আমার স্কুলের কোনো শিশুর
সাথে দেখা হলে বলে , ম্যাস্টর , কোতি যাও, চাল-আলু কবে
দিবা ? ওদের
আর দোষ কী? প্রতিকূল
পরিবেশে জগদ্দল পাথর চাপা পড়ে ওরা সংস্কার শিখতে পারেনি । আবার শুধুই সিস্টেমের দোষ দিলে হবে না । শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিজস্ব ভূমিকা নিয়েও
ভাবতে হবে । আর দুঃখ হয়, চতুর্থ শ্রেণি পাশ করেও যখন কোনো শিশু বাবা-মায়ের নাম লিখতে পারেনা, বাংলা পড়া ভালো করে পড়তে পারেনা, যোগ বিয়োগ করতে
পারে না । পারবে কী করে? সাদা পাতায় কিছু না লিখলে লেখা ফুটে উঠবে কী করে ? আমরা যদি আয়নায় প্রত্যেকে নিজেকে দেখি আর প্রশ্ন করি –‘আমি কে?’ আর যদি ভাবি –‘বাচ্চাগুলো কিছুই শিখছেনা । আমরা ৩০ – ৩৫/৪০ – ৪৫ হাজার টাকা মাইনে পাই, সমাজ তো আমাদের কাছে
কিছু আশা করে ।……….. ।’ হয়তো কেউ কেউ অবশ্যই ভাবি। কিন্তু মুশকিল সেখানেই,যদি অগণিত কন্ঠে উত্তর আসে
– ‘কষ্ট করে চাকরিটা পেয়েছি, এখন তো একটু আরামে থাকতেই হবে ।’ দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলোর মনেও এখন আর কোনো ব্যথা নেই ।
ওরা প্রতিবাদ করে না। মিড – ডে -মিলের খাবারটা পেলেই হল আর স্কলারশিপের টাকাটা একাউন্টে ঢুকলেই হল । ব্যাস, ‘মাস্টারমশাই
– দিদিমণিরা খুব ভালো ।’
সমাজের প্রতি দায়িত্ব, আগামী প্রজন্মের প্রতি কর্তব্য শুধু দাদাভাই, দিদিভাইরা কাঁধে তুলে নিয়েছেন । পাঠদানের মধ্যে যেমন পরিশ্রম আছে তেমন এক
অনাবিল আনন্দও আছে । আবার সামনে বসে থাকা শিশুটি কতটা শিখলো তার মধ্যেও অপার আনন্দ
আছে । এই পরিশ্রমের পেছনে কোন কষ্ট নেই , ক্লান্তি নেই , আছে অফুরন্ত সুখের অনুভূতি, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার শীতল স্পর্শ, যার সন্ধান এই
অবক্ষয়ের যুগে শিক্ষক-শিক্ষিকারা পায়নি কখনও। আমাদের সামনে উদাহরণ আছে
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্রফেসর মেঘনাদ সাহা, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য
প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ
প্রমূখ ব্যক্তিত্ব । তাঁদের সোনা
ফলানো উর্বর জমিন আজ বন্ধ্যা হয়েছে। পুনরুদ্ধারে ব্রতী হয়েছেন দাদাভাই-দিদিভাইরা ।
শিশুরা ছাত্র-ছাত্রী নয়, ভাই – বোন । এতটা আপন হতে পারা, কাছে আসতে পারা একমাত্র শিশু মন্দিরেই সম্ভব, বিদ্যালয়ে নয় । তাইতো বড় আপনার সেই ভাই-বোনেরা কাঁধে
লাফিয়ে ওঠে, কোলে চড়ে বসে । আর বিদ্যালয়ে আমি দেখেছি – শিক্ষক বা
শিক্ষিকা কারও জামা বা শাড়ির আঁচল কোন বাচ্চার শরীর স্পর্শ করলে তা বারবার ঝেড়ে নিতে । ‘ছি! দেখে চলতে পারিস না?’ এমন ধমকও খেতে হয় । বিকৃত মুখাবয়বের সামনে কচি মুখগুলো
কালো হয়ে যায় । আমাকেও একবার সেই বিদ্রুপ বাণী শুনতে হয়েছে ।
একবার খেলা করতে করতে একটি বাচ্চাকে আমি
কোলে তুলে নিয়েছিলাম । আমার পোশাকে সামান্য
ধুলো লেগে গিয়েছিল । তাতে আমি অপরিচ্ছন্ন এবং
অস্পৃশ্য হয়েছিলাম । তবে এসবে পরোয়া না করে সত্যিই আমি
ধূলায় ধূসরিত হই বারবার । বাচ্চারা আমার কাছে আসে, হাত ধরে টানাটানি করে । বলে – “ স্যার, একটা ছড়া বলো, একটা গান করো ।” আমি তখন তৃপ্তি অনুভব করি, যেন হারিয়ে যাই সেই আমার পুরনো শিশু মন্দিরে ।
শিশু মন্দির যেন আমার শৈশবের
‘সেকালের’ প্রতিচ্ছবি । এখানে পঠন-পাঠনের পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধূলা, মনীষীদের জীবন চর্চা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । দিদিভাই –
দাদাভাইরা শিশুদের বাড়ি বাড়ি যান আত্মিক সম্পর্ক গড়তে । এত পরিশ্রমের ফল বৃথা
যাবে না। ভোরের আলোর অমিত তেজে চারাগাছগুলো একদিন বৃক্ষে পরিণত হবে, তাঁরা গড়ে তুলবে নতুন ভারত । শিক্ষক-শিক্ষিকারা যা পারেনা, দাদাভাই – দিদিভাইরা তা অনায়াসে সফল করে তোলেন । জানি, তাঁরা অনেক কষ্ট স্বীকার করেন । অবশ্য মহৎ কাজে কষ্ট বলে কিছু নেই । প্রদীপ নিজেকে
অন্ধকারে রেখেই জগৎকে আলো দেয়।
: শেষ কথা:
আমার আদর্শ, চলার পথ কিছুটা আলাদা
হলেও যা সত্য তা স্বীকার করলাম মুক্তমনে ।
“ সত্য যে কঠিন, সেই কঠিনেরে ভালবাসিলাম,সে আমাকে
কখনও করেনি বঞ্চনা ।” প্রার্থনা করি – ভোরের আলোয় মুছে যাক সব অন্ধকার , মুছে যাক সব ভেদাভেদ। “ভোরের পাখি ডাক দিয়েছে, আয়রে ছুটে আয় । নিদ্রা
ভেঙে, নয়ন মেলে আয়রে ছুটে আয়
।”