![]() |
(ছোট গল্প) |
আমাদের দেশে বারো মাসে তেরো পার্বণের কথাটা প্রবাদে পরিনত হয়েছে অনেক আগেই। এখন নতুন যুগে বছর জুড়ে ভোটও উৎসবের স্বীকৃতি পেয়েছে। কেননা,ভোটেরও শেষ নেই। যেমন – পঞ্চায়েত ভোট, পৌরসভার ভোট,বিধানসভার ভোট,লোকসভার ভোট,রাজ্যসভার ভোট। এছাড়াও আছে উপভোট, সমবায় সমিতির ভোট,স্কুল-কলেজের ভোট প্রভৃতি।
তাই সারাটা বছর ধরেই বসে ভোটের বাজার। এই বাজারের দোকানিরা ক্রেতা, জনগণ বিক্রেতা। দোকানিরা হরেক রকম লোভনীয় প্রতিশ্রুতি দিয়ে পসার সাজিয়ে বসে। এইসব প্রতিশ্রুতির দ্বারা চলে আকৃষ্ট আর খুশি করার প্রতিযোগিতা। চলে কুটকৌশল আর শকুনির পাশা খেলা। খেলায় কেউ হারের ইঙ্গিত পেলে নির্ঘাত জোরজুলুম।
জনগণ আসে ভোটার সেজে। দোকানিরা প্রতিশ্রুতির ডালি খুলে দেয়। ভোটাররা সেসবে উদ্বুদ্ধ হয়ে যার কাছে বেশি দাম পায় তাকেই ভোট বেচে। আবার এই পন্য অবস্থা বিশেষে দোকানিরা দাম না দিয়ে কেড়েও নেয়।
সামনেই এখন ভোট। ভোটের বাজারে পসার সেজে উঠেছে সারি সারি। ভোটার টানতে চলছে তুমুল প্রচার। শুনতে পাচ্ছি, দেখতেও পাচ্ছি –
“ঢাক বাজে, ঢোল বাজে ,
মাইক বাজে, ডিজে বাজে,
বাজে রসের গান।
জনতার শরীর দোলে,
মিষ্টি গানের তালে তালে ,
ঘরের কোণে রয় কি পড়ে মন?
মা বলে , বোন বলে ,
হৃদ-মাঝে বড়ো উচাটন,
চলো, নিয়ে আসি লক্ষ্মীর ধন।
বধূ বলে , শাশুমা বলে ,
দেবে আরও কত যে রতন ,
ওগো ,ওরাই যে কলির ভগবান।”
দল বেঁধে আসে ভোটার। দোকানিরা স্বাগত জানায়, আপন আপন মিষ্টি-মধুর ভাষায়।
পসার একঃ “আয় ভোটার আয়,ছুটে ছুটে
আয়। দিয়ে যা ভোট,পাবি
বড়ো নোট। ওই দোকানি
ভালো নয়,আমরা বড়ো
ভালো। আমাদেরকে বেচলে
ভোট, ঘুচবে তোদের কালো।
ওরা হতচ্ছাড়া,হতশ্রী,সেজেগুজে
হয়েছে রূপশ্রী, জাতপাতের
খেলা নিয়ে দেয় শুধু সুড়সুড়ি।
ভোট দেবে না ওদের কেউ
প্রতিজ্ঞা করো,বাঁচার মতো
বাঁচবে যদি আমাদের হাত
ধরো।”
পসার দুইঃ “কী বললি,ওরে
লক্ষ্মীছাড়া,সর্বনাশী?
গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে
সেজেছিস্ ফ্যাসিবাদী। মানুষ
তোদের খুলবে মুখোশ,ছুঁড়ে
ফেলে দেবে। ওরে ভোটার
আয়,ভোট দিতে আয়। অথৈ
জলে ডুববি না আর, মিলবে
তোদের ঠাঁই। হলফ করে বলছি
ওগো, সোনার বাংলা গড়বো
মাগো, তোমাদের হবে না
নির্যাতন। ঘরে ঘরে আসবে
সুদিন, এই বাংলায় কেউ রবে
না দীন, থাকবে না কেউ হীন।”
পসার তিনঃ “ওরে ও মায়াবিনী, ছদ্মবেশী,
তোরা দুজনেই ভারী
মিথ্যাবাদী, অত্যাচারী,
সর্বদোষী, অপরাধী। অপরাধ
ঘটালি কত! তার কি হিসেব
দিবি? মা-বোনেদের চোখের
জলে, দেশটা মোদের নিত্য
ভাসে। তাইতো তোদের ভোট
নেই, ভোট নেই, ভোট নেই।
আয়রে ভোটার আয়, এই
দোকানে আয়। আমাদেরকে
দিলে ভোট, বাড়বে তোদের
আয়, চাকরি পাবি আয়।
অহিংসার পূজারি আমরা,মিথ্যে
কথা বলি না।”
পসার চারঃ “ ওরে ভোটার শোন্, কান পেতে
শোন্, বাজে কথায় দিস্ না
তোদের মন। এই কথাটা মনে
রাখিস্, যদি আমাদের আপন
ভাবিস্, বুঝবি তোদের কেন
অনটন। পরলোকে নয়, এই
ভুবনেই নিশ্চয়, গড়বো মোরা
জীবনের স্বর্গরাজ্য। সবাই এসে
হাত মেলাও,করো শপথ, সবারই
জীবন হবে ধন্য।”
ভোটাররা দিশেহারা, কাকে ভোট দেবে?ভাবছে – দোকানিরা প্রত্যেকে অন্যদেরকে খারাপ বলে, নিজেদেরকে ভালো বলে। ভোট কিনে নিয়ে সিংহাসনে বসলেই ব্যাস্, আমাদেরকে ভুলে যাবে।
দোকানিরাও প্রত্যেকে ভাবছে – মন ওদের গলেনি। এখনও ওদের মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারিনি। তাই আবারও শুরু হয় মধুর ভাষণ, প্রতিশ্রুতির বন্যা।
পসার একঃ “ও আমার মা-জননী,
দাদা-দিদিরা । দেখো এসে
দুচোখ মেলে, কেমন
সাজিয়েছি পসরা! গৃহ তৈরির
টাকা দেবো, জমি চাষের খরচ
দেবো, বিনে পয়সায় দেবো
পানীয় জল। বিপদ যদি আসে
দ্বারে, ঝড়-তুফান আর বানের
জলে, কেউ ভাসবে না আর,
পড়বে না চোখের জল। চেয়ে
দেখো ,তোমাদের দুয়ারে এসেছি
মাগো,নিয়ে লক্ষ্মীর ধন।
মেয়েদের লাগি ভাবনা কীসের ,
এনেছি বিয়ের পণ। যুবক
ছেলেরা,কাটবে এবার হতাশা।
তোমাদের জন্যও এনেছি
ভাতা।”
দলে দলে মানুষেরা এগিয়ে এসে বলে, “বেশ, বেশ, তবে তো ভালোই হবে।”
“ ও আমার বেকার ভাই, বেকার
বোনেরা, জীবনের স্বপন যত, যত
বাসনা। পালিছ বুকের মাঝে মহা
যতনে,বৃথা যাবেনা ওগো, লীন
হবে না মরীচিকা হয়ে। অনুদানের
অর্থ এনেছি, এনেছি শিল্প। বিনা
কলেই শিল্প হবে, জীবন সবারই
ধন্য হবে।”
“তা কী শিল্প এনেছো শুনি?”
“এই দেখো না – বান এসেছে
রকমারি শিল্পে। কাশফুলেতে
বালিশ হবে, অলিগলিতে চপ
ভাজবে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে
কাগজের কাপে ঢেলে বেচবে
ওগো চা। ঘুগনিটাও ভালোই
হবে,স্বাদে-গন্ধে ভরপুর
হলে,কাতারে কাতারে মানুষ এসে
লাইন দেবে।”
উৎসাহিত হয়ে বেশ কিছু লোকজন, যুবক-যুবতী এগিয়ে আসে। সানন্দে অনুদান গ্রহণ করে।
পসার দুইঃ “অখন্ড ভারত গড়বো মোরা,
সিন্দুর জলে বইবে আর্যধারা।
আমরা কেউ নই আলাদা, কেউ
নই আলাদা। জাতি-ধর্ম
নির্বিশেষে কেউ নই আলাদা।
অতীতের যত পূর্বপুরুষ,
করেছিল বিরাট ভুল। চার বর্ণের
বিভেদ ভুলে, সবাই এবার
খেলবে একই মায়ের কোলে।
উচ্চবর্ণের অত্যাচারে, রামায়ণের
বাণী ভুলে ,কোরাণের বাণী
নিয়েছিলে মুখে। সেদিনের সব
বিভেদ এবার হবে নির্মূল।
মা-বোনেরা,শোনো তোমরা,
রাবণ এবার হবে নির্বংশ। মুছবে
সীতার চোখের জল, ঘুচবে সব
কলঙ্ক। দুঃশাসন আর
দুর্যোধন,বৃথাই ওদের গর্জন,
দ্রৌপদীরা গলা টিপে করবে
ওদের নিধন।”
“ তাই? তবে তো সুশাসনের রাজ্যে আমরা নিশ্চিন্তে, নিরাপদে দিন কাটাতে পারবো,” এই বলে শান্তিপ্রিয় মানুষেরা এগিয়ে এলো দলে দলে।
এই দৃশ্য দেখে প্রসার এক -এর দোকানির চোখ লাল হয়ে উঠলো।
পসার তিনঃ “সবার উপরে মানুষ সত্য, তার
উপরে নেই। মানুষ শুধুই মানুষ
ও ভাই, তার আর কোনো জাত
নেই। ধর্ম তোমার ব্যক্তিগত,
আমাদের তাতে বাধা নেই।
গণতন্ত্রের সাধনা করি,
অসহিষ্ণুতা, বিভেদ,
জাত-পাতের ছোঁয়া নেই।
সুশাসন শুধু আমরাই দিতে
পারি, আর কেউ নয়। দুর্নীতি,
দালালি, সিন্ডিকেট, কাটমানি,
চাকরি চুরির নেই ভয়। যোগ্যরা
পথে পথে কেঁদে মরে,
অযোগ্যরা কলম ঘুরায় স্কুল,
অফিস,আদালতে।
কামিনী-কাঞ্চনের স্বপ্ন দেখি না
আমরা টাকার পাহাড়ে শুয়ে,
কারও কথা-বলার স্বাধীনতা
নিই না কেড়ে মাওবাদী বলে
দেগে। যত অপকর্ম,
অপসংস্কৃতির এখন মুক্ত
বাজার, দেদার ডিজে বাজে,
বাজি ফাটে,নেশার ঘোরে ফুর্তি
করে, প্রশাসন নির্বিকার। এসো
ভাই, এসো দাদা, এসো দিদি ,
এসো আমার বোন, আমাদের
দিলে ভোট, এসবের হবে
নিরসন।”
এমন আহ্বান শুনে বহু মানুষ ভরসা পায়, এগিয়ে আসে। প্রসার এক – এর দোকানির ক্রোধ আরও বাড়তে থাকে।
পসার চারঃ “ বন্ধু ওগো, সাম্যের পৃথিবীতে,
মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা যাবে ঘুচে।
পুঁজিবাদ ধ্বংস হবে যবে,
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
পৃথিবীতে সবার, সবারই
অধিকার বাঁচার। রাজনীতি শুধু
বুদ্ধিরই নয়, হৃদয়ের কারবার।
ত্যাগের আদর্শ নেই যেখানে,
লুটের রাজত্ব সেখানে। যত
অন্যায়, অবিচার, ব্যাধি এসে
খড়গ ধরে। জুড়ায়না
যন্ত্রনা,জীবন ছটফট করে
মরে। আজ এই অসাম্যের
ভুবনে বলীয়ান সব ধন লুটে
নেয়, দুর্বল বৃথাই কেঁদে মরে,
পথের ধুলায় লুটায় হেলায়।”
সর্বহারা, শ্রমজীবী, দুর্বল ও নিঃস্বার্থ মানুষেরা বুকে বল পায়, অনুপ্রেরণায় এগিয়ে আসে।
পসার এক – এর দোকানির এবার সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে তার জয় নিশ্চিত করতে চায়। তার যে অসীম শক্তি। তার হাতে পুলিশ আছে, প্রশাসন আছে। অর্থবল আছে, পোষ্যবাহিনী আছে। তার মধুর ভাষণ এবার পরিণত হলো কদর্য ভাষণে।
“তোদের গায়ের চামড়া ছিঁড়ে,
বানাবো পায়ের জুতো। লাঠি মেরে,
ডাণ্ডা মেরে, বোমা মেরে, গুলি ছুঁড়ে,
সব শালোকে হত্যা করে কবর
দেবো। ওরে ও পোষ্যবাহিনী,
সুশাসনের ধ্বজা নামা,গণতন্ত্রের
নামাবলিটা ধূলায় লুটা। নাচ ওরে
নাচ রুদ্রদেবের প্রলয় নাচন,
অস্ত্রগুলোয় উঠুক আওয়াজ
ঝনঝনাঝন। যা ছুটে ঐ
ভিড়ের মাঝে,অপ্সরাদের হরণ করে
লজ্জা কেড়ে নে। খোলা মাঠে
ভোটের বাক্স সব ভরে নে,সব ভরে
নে। ”
বাজার এতক্ষণে শুনশান। শেষ হয় জবরদখলের ভোট। শুরু হয় বিজয়ের উল্লাস।
এমনি করেই ভোট যায়, ভোট আসে, বাজার বসে। দিন শেষে রাত নামে। অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে আসে।
………………………… ………………………… ..