Girgiti – গিরগিটি

 

ProductMarketingAdMaker 01112022 164251
অণু গল্প

হরবিলাস সরকার

স্মৃতিচারণ সভামঞ্চে উঠে সদ্য কোল-শূন্য মায়ের বিদীর্ণ বুকটা দুঃসহ বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। তারপর অশ্রুনয়নে ছেলের ছবিতে মালা পরালো। লক্ষ্য কণ্ঠে তখন আওয়াজ উঠল, “ শহীদের রক্ত, হবে নাকো ব্যর্থ। শহীদ স্মরণে, আপন মরণে, রক্তঋণ শোধ করো।…………।”


বিশিষ্ট জননেতা, জনতার অত্যন্ত কাছের মানুষ, রাজনীতির ময়দানে যিনি চাণক্য,  সেই মুকুন্দ রায় দলের একনিষ্ঠ সংগঠক কর্মী ‘দিবাকর মজুমদার’ যাঁর বৃহৎ অবদানে পরিপুষ্ট সোনামূখীর সংগঠন, তাঁর স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে উঠলেন। “আমার প্রিয় মা-বোনেরা, ভাই, দাদা-দিদিরা, পিতৃসম অগণিত মানুষজন, আপনারা সকলেই জানেন – আজ আমাদের কাছে অত্যন্ত দুঃখের দিন। আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতাসম ‘দিবাকর’ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। যাঁর আমার স্মৃতিচারণ করা উচিত ছিল, তাঁরই কিনা আমি স্মৃতিচারণ করছি।”


শোকাহত মা এ সময় নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না, ভূমিতলে লুটিয়ে পড়ল। মুকুন্দবাবু দু’হাতে মাকে তুলে বুকে টেনে নিলেন। অশ্রুধারা তাঁরও দুগাল বেয়ে প্রবাহমান। বললেন, “ মা, কেঁদোনা, সন্তান শুধু তুমিই হারাওনি, আমিও আমার ছোট ভাইকে হারালাম। আমি তোমার বড় ছেলে মা।” এরপর জনতার উদ্দেশ্যে বললেন,  “আপনাদের সবার চোখেই জল। আসুন, এই জলভরা চোখে হাতে হাত মিলিয়ে সবাই প্রতিজ্ঞা করি – দুষ্কৃতী-আশ্রিত,সৈরাচারী,গণতন্ত্র হত্যাকারী যে দল নিজেদের হীন-স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য একটা ফুলের মত সুন্দর জীবন কেড়ে নিল,  সেই দলের অনতিবিলম্বে পতন দেখতে চাই। সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। ভোট-মেশিনে বোতাম টিপে ওদের বিদায় ঘন্টা বাজাতে চাই।”


সাথে সাথে চারদিকে আওয়াজ উঠল, আকাশে-বাতাসে অনুরণিত হল,  “দুষ্কৃতী-আশ্রিত, গণতন্ত্র হত্যাকারী, স্বৈরাচারী দলের ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই। জীবন হত্যাকারী, নারী নির্যাতনকারী শাসক তুমি দূর হটো, দূর হটো।…………।”


মুকুন্দবাবু হাত তুলে থামতে বললেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন, “ প্রিয় সাথীগণ, দিবাকরের অবদানের কথা আমরা কোনদিন ভুলতে পারবো না। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও কলেজ ছাত্রীটির সম্মান বাঁচানোর জন্য একা রুখে দাঁড়িয়েছিল সে। নির্জন রাস্তার ধারে সোনামুখীর গভীর জঙ্গলে ঘাতকেরা প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই। পুলিশকে ফোন করলেও আসেনি। ওই জঙ্গলে নিত্যদিন দুষ্কৃতীরা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বহু অন্যায় কার্যকলাপ চালায়। দিবাকর ওদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে ওঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর সমর্থন দুষ্কৃতীদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তারই জেরে প্রাণটা দিতে হলো আমার ছোট ভাইকে। তাই আজ সময় এসেছে বন্ধু। আমরা যদি এই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটাতে পারি, তবেই এই সন্তানহারা, হতভাগী মা শান্তি পাবে, আর দিবাকরের প্রতিও যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে। সে বেঁচে থাকবে চিরদিন আমাদের হৃদয়ে।”


আবারও চারিদিক মুখরিত হল আওয়াজে। “দিবাকর অমর রহে। দিকে দিকে দিচ্ছে ডাক, অশুভ শক্তি নিপাত যাক্। সব মানুষের একজোট, স্বৈরাচারীর নেই ভোট।……………।”


নৌকার পালে সত্যি সত্যিই হাওয়া লেগে গেল। সোনামূখীর চারপাশের মানুষ জোটবদ্ধ হয়ে গেল। ওদিকে ঝনঝনিয়ে উঠল স্বৈরাচারীর অস্ত্র। পায়ের তলার মাটি কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেবে না। রক্তে রাঙা হলো মাটি। ভোটের দিন বুধ দখল, ছাপ্পা ভোটের মরীয়া চেষ্টা। বুক চিতিয়ে দাঁড়াল দিবাকরের দু’বছরের বড় দাদা প্রভাকর। নিমেষে দুটো গুলি বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল।  শুধু একবার ‘মা’ বলে ডেকে উঠেছিল। তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আবারও সেই নিদারুন শোকের ছায়া।

ProductMarketingAdMaker 01112022 171004


শোকের আবহেই নির্দিষ্ট দিনে ভোট গণনা হয়ে গেল। বিধায়ক পদপ্রার্থী মুকুন্দবাবু বিপুলভোটে জয়ী হলেন তাঁর কেন্দ্র থেকে। মানুষের চোখের জল আর জয়ের আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। শোকাহত মা দু’হাতে বুক চেপে ধরে দৃঢ় কন্ঠে বলল, “ পৃথিবী, আজ আর আমার কেউ নেই। তোমার মাটিকে কলুষমুক্ত করতে আমি আমার দুই সন্তানকে তোমার কোলে উৎসর্গ করলাম। তুমি ওদের আশীর্বাদ ক’রো।”


এত আত্মত্যাগ সত্ত্বেও স্বৈরাচারকে অবশ্য সরানো গেল না। অনেক আসনে হারলেও ক্ষমতায় সে-ই টিকে রইল। শয়তানের ছলের অভাব হয় না। সেই ছলে স্বেচ্ছায় পা মেলালেন মুকুন্দবাবুও। শাসক দলে নাম লিখিয়ে মন্ত্রীত্বও পেয়ে গেলেন। অভিপ্রায় পূর্ণ হয়েছে তাঁর। আর যে অতীত তাঁকে জয়ের শিখরে পৌঁছে দিল, তা তিনি বিস্মৃত হলেন অবলীলায়।


সোনামুখীর মাটিতে এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে। তার আকাশে-বাতাসে এখনও অনুরণিত হয় – “মা কেঁদোনা। …………। আমি তোমার বড় ছেলে মা।”

……………………………………………………….