ছোটগল্প | |
মরণ খেলা | – হরবিলাস সরকার |
খেলা হবে, খেলা হবে,
বাংলা জুড়ে খেলা হবে।
সামনে নির্বাচন। অদূরের কোন জনসভার মঞ্চ থেকে এই আওয়াজ ভেসে আসছিল। ষষ্ঠ শ্রেণির বর্ষা বাবাকে জিজ্ঞেস করল, কী খেলা হবে বাবা? বাবা কৌতূহলী মেয়েকে বুঝিয়ে বলল, শোন্ মা, এই খেলা ফুটবল, ক্রিকেট খেলা নয়। লুডো, দাবা খেলাও নয়। এ অন্য খেলা। ক্ষমতা দখলের খেলা। মন্ত্রিত্ব লাভের খেলা। কিন্তু বাবা, মন্ত্রী তো ভোটে জিতে হয়। হ্যাঁ…, তাইতো। জিততে গেলে খেলতে হবে না?
অবুঝ বর্ষা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী রে মা, বুঝলি না তো? এ খেলা মাঠে-ময়দানে হয় না। এ খেলা নেতায় নেতায় হয়। খেলায় কী গোল হয়? হয়, তবে অন্যভাবে। আসলে কী জানিস, ছলে-বলে-কৌশলে যে যত বেশি মানুষের সমর্থন আদায় করে ভোট-বাক্সে ফেলতে পারে, তারই জিত হয়, মন্ত্রিত্ব লাভ হয়।
বর্ষার দিদি ‘সুনয়না’ দ্বাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের ছাত্রী, পাশের ঘর থেকে সব শুনছিল। এসে বলল, বাবা, রাজনীতি তো বুদ্ধিমানের হৃদয়বৃত্তির কারবার, মানবসেবার কারবার। তা খেলা হবে কেন? খেলায় জিততে ছল, বল, কৌশল খাটাতে হয়, জানি। যদিও ভালো খেলোয়াড়ের শিল্পনৈপুণ্যটাই একমাত্র এবং প্রধান গুণ। আর রাজনীতি, তা তো ন্যায়-নীতি, আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত।
মুখে তুমি ফোটাও যতই
সুমধুর বুলি,
লক্ষ্যভেদে চাই হাতে
বন্দুক আর গুলি।
খেলায় যতই ভালো খেলো,
গোল ছাড়া বৃথা,
বিজয়-মুকুট পরতে গেলে
গোলটাই আসল কথা।
এসব কথার মানে কী বাবা? এই দেখ্ মা, রাজনীতিতে হৃদয়বৃত্তি, নীতি-আদর্শ শুধুই কথার কথা। ওসব নিয়ে চললে মানছি – মানুষের কাছে ভালো মানুষ হওয়া যায়। কিন্তু ভোটে জেতা সম্ভব নয়। ভোটে জিততে গেলে একটাই পথ, খেলতে হবে। ভয়ংকর খেলতে হবে। তবেই ক্ষমতা হাতের মুঠোয় আসবে। মন্ত্রীর চেয়ারে বসার সাধ পূর্ণ হবে।
তুমি যা বলছো, সে তো মরণ খেলা বাবা। না বাবা, তুমি এমন রাজনীতি ক’রো না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা অথৈ সাগরে ভাসবো।
শোন্ রে মা, ওই যে জনসভা
নিরন্তর ডাকে আমাকে,
জীবনের সব আশা পূর্ণ হবে,
দল ভোটে জিতে গেলে।
এই বলে বাবা সমাবেশে চলে গেল। চোখে, মুখে একরাশ ভয় নিয়ে বর্ষা দিদিকে শুধোয়, মরণ খেলা কী দিদি? শুনবি? তবে আয় আমার ঘরে।
সুনয়নার ঘরে মাও চলে এলো। কী রে, তোরা কী নিয়ে আলোচনা করছিস? মরণ খেলা মা। তোমার মনে আছে? হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? ইতিহাসে পড়েছি। দাসপ্রভুরা এই মরণ খেলা চালু করেছিল। একজন ক্রীতদাসের সঙ্গে আরেকজন ক্রীতদাসের কিম্বা একজন ক্রীতদাসের সঙ্গে একটা হিংস্র জন্তুর লড়াই বাঁধিয়ে দেওয়া হতো। যতক্ষণ না একপক্ষের মৃত্যু হতো, ততক্ষণ এই লড়াই চলত। ওমা! কী সাংঘাতিক! নৃশংস মৃত্যুর খেলা।
তাহলে বুঝেছিস তো বোন? মা বেশ সুন্দর করেই বুঝিয়ে বলল। হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবীর আদিম সভ্যতার যুগ পেরিয়ে এসে নতুন একটা সমাজে মেসোপটেমিয়া, মিশর, গ্রীস, রোম প্রভৃতি দেশে সাধারণ মানুষদের পশুর মতো কেনাবেচা হতো। পশুদের সংগেই গোয়ালঘরে রাখা হতো। তারাই ক্রীতদাস। তাদের জীবন ছিল দুঃখময়। আর ওই ক্রীতদাসদের মালিক যারা, তাদের বলা হতো দাসপ্রভু। তারাই সেই সময় দেশ শাসন করতো। পৃথিবীর সর্বত্রই এমন অমানবিক নিষ্ঠুরতার কমবেশি দৃষ্টান্ত আছে, ইতিহাস তার সাক্ষী।
বুঝেছি সোনা মাগো,
বুঝেছি প্রিয় দিদি,
দাসপ্রভুদের উত্তরসূরিরাই
আজকের নেতা-মন্ত্রী।
সেদিন ছিল যারা সমাজে
অসহায়, অগণিত ক্রীতদাস,
বংশ-পরম্পরায় তারাই আজ
দুনিয়ার মেহনতি মানুষ। প্রদীপের আলোরই চিরসুখ, ভোগবিলাস,
তার নিচে অন্ধকারে ঘটে নিদারুণ সর্বনাশ।
কী দিদি, ঠিক বলিনি? চমৎকার বলেছিস বোন। কিন্তু বোন, সব নেতা-মন্ত্রী যে খারাপ, তা নয়। আজকের আধুনিক সভ্যতার যুগে অনেক নেতা-মন্ত্রীই চান পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে। মানুষের ভেতরের পশুত্ব বিনাশ হয়ে যেদিন দেবত্ব লাভ হবে, সেদিন স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা লুপ্ত হবে। শোষণ, সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষা মন থেকে মুছে যাবে। শুধুই ত্যাগের আকাঙ্ক্ষায় মন উদ্বুদ্ধ হবে। এই আদর্শে দীক্ষিত হবে যে, আমি সমাজের সেবক, সর্বোপরি মানুষের সেবক। আমি সাধ্য অনুযায়ী কর্ম করে যাবো, বেঁচে থাকবার জন্য যেটুকু প্রয়োজন শুধু সেইটুকুই সমাজ থেকে নেবো, তার বেশি এক বিন্দুও নয়। সেদিন এই মরণ খেলা বন্ধ হবে চিরতরে।
তবে আয় না দিদি, আজ এই দুর্দিনে প্রার্থনা করি ভক্তিভরে –
এসো রামকৃষ্ণ, মা সারদা,
বিবেকানন্দ, দেশে দেশে,
এসো রবীন্দ্রনাথ, দেশবন্ধু,
মহান সুভাষ, মানুষের ঘরে ঘরে।
ত্যাগের মহিমায়, প্রেমের বন্ধনে
জাগাও বিবেক অন্তরে অন্তরে,
জ্বালাও নব দীপশিখা
তমসার ভুবন জুড়ে।
হ্যাঁরে বর্ষা, বোন আমার, তোর মত আমিও বলতে চাই –
হিংসার পৃথিবী নয়,
এসো শান্তির বাসভূমি গড়ি আমরা,
মহামিলনের সাগর পাড়ে
বিলীন হোক নিষ্ঠুর মরণ খেলা।
মা সুনয়না, তুই কি তোর বাবাকে নিয়ে ভয় করছিস? হ্যাঁ মা, দাসপ্রভুরা মরণ খেলার আয়োজন করত আনন্দ উপভোগের জন্য। আজকের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা দেশের তথা সমাজের উন্নয়নের কথা মুখে বলে, অথচ নিজেরা ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে পড়ে। দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলো সুদিনের আশায় নেতা-মন্ত্রীদের প্রতি অনুগত হয়। সামান্য দয়া-দাক্ষিণ্য পায় অথবা পাবে বলে আশায় বুক বাঁধে। নেতা-মন্ত্রীরা মাটিতে নেমে আসে, অভাগা-অধমের বন্ধু সাজে। বিনিময়ে ক্ষমতার সিংহাসনগুলো পাকাপোক্ত হওয়ার আশ্বাস কুড়োয়। ওই সিংহাসন লাভের জন্য বিরোধী নেতায়-নেতায় আবার নিজ দলের নেতায়-নেতায় লড়াই বাঁধে। অর্থাৎ যুদ্ধ। যুদ্ধ তো সেনাপতিরা করে না, করে সেনারা। যুদ্ধের ময়দানে শুরু হয় রক্তের হোলি খেলা। কালের পরিবর্তনে নতুন মোড়কে এইতো সেই মরণ খেলা মা।
ওরে সুনয়না, বর্ষা, আমার ভয় করছে মা। তোর বাবাকে এক্ষুনি ফোন করে বল্ বাড়ি ফিরে আসতে। যুদ্ধের বাজনা বাজছে। মেয়েরা শান্ত করে মাকে।
ক্ষণিক বাদে দলের এক কর্মী রক্ত মাখা জামা-কাপড়ে দুঃসংবাদ নিয়ে এলো বাড়িতে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মুখোমুখি দুই দলের মধ্যে নির্বিচারে বোমা-গুলির লড়াই হয়েছে। নিহত সতেরো, আহত শতাধিক। আমাদের দলেরই বেশি কর্মী মারা পড়েছে। পুলিশ এসে দেহগুলো তুলে নিয়ে চলে গেছে। মুখগুলো এতটাই বিকৃতি হয়ে গেছে যে, সবাইকে চেনা গেল না। সুমনা, বর্ষা তোমাদের বাবা কি বাড়ি ফিরেছে? কোথাও তো দেখতে পেলাম না।
মাথার উপর নিমেষে আকাশটা যেন ভেঙে পড়ল। সীমাহীন আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা, দুর্ভাবনায় পথের দিকে চেয়ে থাকে মা, সুনয়না, বর্ষা।
…………………………………………………….