( অণুগল্প )
পরিবর্তন
অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ‘নীলকণ্ঠ আচার্য’
জীবনে কোনদিন ধর্মীয় স্থানে না গেলেও ঠাকুর-দেবতার প্রতি তাঁর ভক্তিতে খামতি ছিল
না। প্রতিবারের ন্যায় এবারও ১লা বৈশাখ ভোর থেকে পাড়ার ‘গোবিন্দ মন্দির’ প্রাঙ্গণে ষোলো প্রহর
হরিনাম সংকীর্তন শুরু হয়েছে। তিনি বাড়ি বসেই তার রসাস্বাদন করছেন। বিকেল পাঁচটা নাগাদ
তিনি দোতলার বারান্দায় বসে বিভোর হয়ে আছেন ঐ দিকেই। কী মধুর সুর ! যেন শ্রীকৃষ্ণ-রাধারানীর
লীলাভূমি ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। হঠাৎ নজরে পড়ল – পাশের রাস্তা দিয়ে বৃদ্ধ
কৃষ্ণদাস বাউল আর তার গিন্নি মীরারানী ভিক্ষাবৃত্তি সেরে একতারা বাজিয়ে গান গাইতে
গাইতে বাড়ি ফিরছেন। ‘বনমালী গো,পরজনমে হইও রাধা।’ “আ! চমৎকার, এ যে হৃদয়কে নদীর
উথাল-পাথাল ঢেউয়ের মতো নাড়িয়ে দিল । কিন্তু এই সময়ে কেন ? এই সময়ে তো দুজনে দিনরাত
মন্দিরেই পড়ে থাকেন। নিজেরা রাধাকৃষ্ণ
সেজে রাসলীলা পরিবেশন করেন। একথা তো আমার স্ত্রীর মুখে কত শুনেছি।” ভাবতে ভাবতে কৌতূহল
সামলাতে না পেরে নীলকন্ঠবাবু ওপর থেকে জোরে হাঁক দিলেন, “আরে ও কৃষ্ণদাস মশায়,
একটু দাঁড়ান, কথা আছে।”
বাউল আর তার গিন্নি দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে উপর
দিকে চোখ ফেলতেই দেখলেন – নীলকন্ঠ মাস্টেমশায়ের কী যেন জানবার অধীর আগ্রহ। বাউল জিজ্ঞেস করলেন – “কী মাস্টেমশায় ?” নীলকন্ঠবাবু
তড়িঘড়ি নীচে নেমে এসে বললেন, “আরে দাদা, কীর্তনের আসর ছেড়ে এভাবে ……,
এমন তো কোনদিন ঘটেনি।” একগাল হেসে বাউল
উত্তর দিলেন, “দিনকাল এখন পাল্টে গেছে। অল্প বয়সী শিল্পীরা এখন আসর মাতিয়ে তুলছে। চোখ ধাঁধানো সাজগোজ, কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে,
শরীরকে কতভাবে খেলিয়ে খেলিয়ে কীর্তন গাইছে । আগে যেখানে বয়স্করা ঠাকুরের নাম-গান
শুনতে আসতো এখন সেখানে ডাগর-ডোগর ছেলেমেয়েরা এসে ভীড় জমাচ্ছে। বড় বড় টাকার নোট ওদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। আমরা তো ব্রাত্য হয়ে পড়েছি গো।”
বাউল-গিন্নি এবার বলে উঠলেন, “মাস্টেমশায়,
শুধু কি তাই ? এখন তো ঠাকুর-দেবতার পূজার্চনার ভার যুবক-যুবতী ছেলেমেয়েরাই নিচ্ছে।
এই ধরুন কালীপূজা, শিবপূজা বা সরস্বতী
পূজা। আগে তো গোটা পাড়ায় একটাই পূজা হত।
এখন মোড়ে মোড়ে, আনাচে-কানাচে পূজা হচ্ছে।
চাঁদা নিয়ে জোর-জুলুম হচ্ছে। দিনরাত ডিজে বাজছে । নাচ-গান হচ্ছে। মদ-মাংস হচ্ছে। চারদিন, পাঁচদিন, সাতদিন ধরে ফুর্তি
চলে।” গিন্নির কথার সাথে বাউল আরও যোগ
করলেন – “ভক্ত বেড়েছে মাস্টেমশায়, ভক্তি নেই। এর চেয়ে নাস্তিকেরাই বরং ভালো । তবু তারা একটা আদর্শ নিয়ে চলে ।” চোখ
দুটো তার অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল ।
বাউল, বাউল-গিন্নি চলে গেলে নীলকন্ঠবাবু ভাবতে
লাগলেন, “এমন আধুনিক সমাজ তো আমরাই আমন্ত্রণ করে এনেছি। ……………।”