–
শুক্লা বিশ্বাস সরকার
একদিন সুখনগরের রাজা,
রানী
ও রাজকন্যা মলয় পর্বতে বেড়াতে এলেন ।
সেখানকার সৌন্দর্য দেখে তাঁরা প্রত্যেকে খুব মুগ্ধ হলেন । রাজামশাই তখন মনে মনে ভাবলেন, “এখানে কিছুদিন কাটিয়ে গেলে মন্দ হয় না ।” সেই মতোই
কাছাকাছি সেখানে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা
হয়ে গেল ।
পরদিন ভোর রাতে রাজামশাই-এর ঘুম
ভেঙে গেলে সৌন্দর্যের টানে একাই পর্বতের দিকে এগিয়ে গেলেন । আকাশের গায়ে তারারা তখনও দীপ জ্বেলে রেখেছিল । এদিকে পর্বতের চূড়ায় বসে রাতের আহার শেষ করে এক মায়াবী
রাক্ষসী আর তার মা তাদের বাসার দিকে
ফিরে যাচ্ছিল । দূর থেকে রাজাকে দেখে তারা নিজেদের রূপ পাল্টে এক অপরূপা সুন্দরী কন্যা ও বিধবা বয়স্কা মায়ের
সাজে রাজার সামনে এসে উপস্থিত হল । রাজার দুচোখের দৃষ্টি তখন
সুন্দরী কন্যার দিকে । তা দেখে বিধবা হাত
জোড় করে প্রার্থনা জানালো,
“মহারাজ, আপনি আমার কন্যাটিকে গ্রহণ করুন ।” রাজা তাঁর
দৃষ্টি বিধবার দিকে ফিরিয়ে বললেন,
“ক্ষমা
করবেন, তা সম্ভব নয়। আমার
স্ত্রী ও এক কন্যা আছে ।” সুন্দরী কন্যা
তখন রেগে গিয়ে রাক্ষসী রূপ ধারণ করে বলল,
“আমি যা চাই তাই করি ।” ইতিমধ্যে রাজার খোঁজে
রানী ও রাজকন্যা পর্বতে চলে এসেছেন । মায়াবী রাক্ষসী দেখল – এই তো সুযোগ । এক মুহূর্তে সে তার মা আর রাজকন্যাকে
নিয়ে শুন্যে উঠে গেল আর চেঁচিয়ে বলল, “রাজা, আমাকে বিয়ে করলে
রাজকন্যা পাবে, নয়তো নয় ।” তারপর
উচ্চঃস্বরে হাসতে হাসতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল ।
শোকাচ্ছন্ন রানীমা কাঁদতে কাঁদতে
বললেন , “মহারাজ, আমার কন্যাকে খুঁজে নিয়ে আসুন, নইলে আমি কেমন করে বাঁচবো!” রাজা সান্ত্বনা দিলেন, “শান্ত হও রানী । আমি অবশ্যই
আমাদের মেয়েকে খুঁজে নিয়ে আসবো।” এরপর পর্বত ত্যাগ করে দ্রুত সুখনগরের প্রাসাদে ফিরে এলেন । মন্ত্রী, সেনাপতি ও অন্যান্য সকলকে
দুঃসংবাদটা জানালেন । তারা বিলম্ব না করে চতুর্দিকে লোক পাঠিয়ে
ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করলেন,
“যে অতিশীঘ্র রাজকন্যার সন্ধান দিতে পারবে তাকে অর্ধেক রাজত্ব দান করা হবে ।” পাশাপাশি
মন্ত্রী, সেনাপতি,
সেপাইরা
নানা জায়গা, নানা দেশে খোঁজ
চালাতে লাগলেন । রাজামশাই নিজেও গোপনে অনেক জায়গায় খুঁজে দেখলেন । রাজকন্যার
কোথাও কোন সন্ধান পেলেন না ।
অনেক বছর পার হয়ে গেল। সুখনগর দুঃখে ভরে উঠেছে । রানীমা
শোকে – দুঃখে অসুস্থ হয়ে শয্যাগত হয়ে পড়েছেন । দেশের বড় বড় বৈদ্য, কবিরাজদের ডাকা হল । তারা একে একে এসে রানীমাকে দেখলেন । সকলেই বললেন, “মহারাজ,
রাণীমার
মনের অবস্থা ভালো নয়, এভাবে অসুখ
সারানো
যাবে না । অসুখ সারাতে গেলে তাঁর মন সুস্থ হয় এমন কোন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে ।”
বৈদ্য, কবিরাজদের খুশি মনে বিদায়
দিয়ে রাজা ভাবতে লাগলেন । তাঁর বন্ধু
রূপনগরের রাজার কথা মনে পড়ে গেল । পাহাড়–পর্বত, নদ-নদী অরণ্য
বেষ্টিত সে রাজ্যটির প্রাকৃতিক পরিবেশের শোভা অতীব মনোরম । মুমূর্ষু রোগীও সেখানে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে
। রাজা তাই তড়িঘড়ি পত্র পাঠালেন বন্ধুকে । পাত্র পড়ে বন্ধুও ভীষণ খুশি । তিনি
দাস-দাসী, পাইক পেয়াদা
সকলকে ডেকে বললেন, “তোমরা সমস্ত
রাজপ্রাসাদ সুন্দর করে সাজাও । আমার প্রিয় বন্ধু সুশোভন আর
তার অসুস্থ স্ত্রী প্রমিলা আসছেন অনেক সুখ দুঃখ নিয়ে । তাদের চোখের জল মোছাতে হবে ।” সর্বক্ষণের সঙ্গী মন্ত্রী
বললেন, “মহারাজ, সবার আগে তো আপনার আর মহারানীর চোখের জল মোছাতে হবে
। একমাত্র রাজপুত্র নীলমণির শোকে আপনাদের হৃদয় পাষাণ হয়ে
গেছে, তবু ক্ষীণ
রেখায় অশ্রুধারা আজও প্রবাহমান ।”
রাজা রুপনারায়ন এবং মহারানী চন্দ্রমুখি সেই
অশ্রুধারা মুছে নিলেন । মন্ত্রী এই দৃশ্য দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে
পারলেন না । দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, “মহারাজ,
দুই দুঃখের সাগর এবার একই ধারায় প্রবাহিত হবে । জানিনা, মহাকালের খাতায় কী ভবিতব্য লেখা আছে !”
এই বলে মন্ত্রী তখন একটি সাদা ঘোড়া নিয়ে রাজপুত্রের খোঁজে পুনরায় বেরিয়ে
পড়লেন । আর এই প্রতিজ্ঞা করে গেলেন – রাজপুত্রের সন্ধান না
নিয়ে তিনি আর ফিরবেন না ।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে মন্ত্রী ক্লান্ত এবং খিদেয় কাতর হয়ে পড়লেন । তখন একটি সুদৃশ্য পালকে মোড়া পাখি উড়ে এসে তার কাছে বসলো আর বন্ধুত্ব পাতালো । মন্ত্রীর কষ্ট অনুভব
করে তাকে পিঠে বসিয়ে একটি সুন্দর
বাগানে নিয়ে গিয়ে কিছু সুস্বাদু ফল
খেতে দিল । এমন সময় এক তরুণ সন্ন্যাসী কোথা থেকে এসে হাজির
হয়ে বলল – তুমি আমাকে দুটো ফল দাও না, আমার খুব খিদে পেয়েছে । মন্ত্রী তৎক্ষণাৎ তার হাতে
কয়েকটি ফল তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কোথায় থাকো বাবা?” সন্ন্যাসী কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকল, তারপর আপন মনে বলতে লাগল – জানিনা কোথায়
আমার বাড়ি ঘর! কী আমার পরিচয়!
মন্ত্রী সন্ন্যাসীর সাথে রাজপুত্রের হুবহু একটা মিল
আবিষ্কার করলেন । হঠাৎ স্মৃতিভ্রংশ
হয়ে রাজপ্রাসাদের ঘেরাটোপ আর কড়া প্রহরা পেরিয়ে রাজপুত্র
একদিন বাইরে বেরিয়ে সেইযে নিরুদ্দেশ হয়েছিল, আর বাড়ি ফিরতে পারেনি । ভাবতে-ভাবতে মন্ত্রী
সন্ন্যাসীকে ভালো করে পরখ করতে লাগলেন । তার জীর্ণ পোশাক আর অসহায় অবস্থা দেখে মন্ত্রীর ভেতরটা বিগলিত হয়ে উঠলো । পাখিটি মন্ত্রীর উদাস
মনের কথা জানবার জন্য বরই উদগ্রীব তখন । জিজ্ঞেস করল , “বন্ধু,
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে – তুমি কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছো, সত্যি কি তাই?” “হ্যাঁ পাখি, তুমি ঠিকই ধরেছো ।” মন্ত্রী তখন রাজপুত্র
নীলমণির ব্যাপারে সব কথা খুলে বললেন পাখিকে ।
সব কথা শোনার পর পাখি মন্ত্রীকে সুপরামর্শ দিল, “বন্ধু,
এই রাজ্যের শেষ প্রান্তে পাহাড় ঘেরা মায়াবী এক বিরাট অট্টালিকা আছে । দিনের আলো ফোটার সাথে সাথে সেই অট্টালিকা অদৃশ্য
হয়ে যায়, রাতের অন্ধকার
নামতেই তা আলোয় আলোয় শোভিত হয়ে ফুটে ওঠে । তার উত্তর
সীমায় দাঁড়িয়ে আছে হাজার বছরের এক বৃক্ষ । সেই বৃক্ষ
নিশুতি প্রহরে চোখ মেলে তাকায়,
মুখ ফুটে কথা বলে । সে অনেক খবর রাখে । হয়তো রাজপুত্র নীলমণির
সন্ধানও সে দিতে পারে । বৃক্ষের পশ্চিম দিকের এক শাখায়
পরজীবী হিসেবে বেঁচে আছে এক লতানো গাছ । সেই গাছের পাতার রস
পান করালে পুরানো স্মৃতি ফিরে আসে । আমি মনস্থির করেছি –
তোমাকে আর এই সন্ন্যাসীকে সেখানে নিয়ে যাবো । তুমি বৃক্ষের
কাছে নীলমণির ব্যাপারে জানতে চাইবে আর
ওই পরজীবী লতানো গাছের পাতার রস সন্ন্যাসীকে পান করালে ওর স্মৃতিও ফিরে আসবে ।” পাখি আরো বলল, “ সেই অট্টালিকায় বাস করে এক মায়াবী রাক্ষসী আর তার
বৃদ্ধা মা । একটা বড় দুঃখের কথাও আছে । ওই অট্টালিকায় এক
রাজকন্যা রাক্ষসীর হাতে বন্দি আছে । সে খুব দুঃখ যন্ত্রণায় কাতর । প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে চেরিদের কড়া প্রহরায় নদীতে স্নান করে আসে, তার পর ছাদে বসে একা একা কাঁদে । আমি ওই বৃক্ষের ডালে বসে সেই করুণ
দৃশ্য দেখি ।”
মন্ত্রী এবার জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা
পাখি, ওই রাজকন্যা কি সুখনগরের
রাজার কন্যা?” “না বন্ধু, সে কথা আমি বলতে পারব না, ওই বৃক্ষকেই জিজ্ঞেস করে দেখো ।”
এরপর পাখি তার শরীরটাকে আকারে বড় করে নিল । তারপর মন্ত্রী আর সন্ন্যাসীকে নিয়ে উড়তে উড়তে চললো বৃক্ষ আর অট্টালিকার
দিকে । সূর্য যখন অস্ত যেতে চলেছে । রাতের অন্ধকার নেমে আসতেই পাখি তার দু‘চোখ থেকে তীব্র আলোকরশ্মি সামনে ছড়িয়ে দিল
। সেই আলোতেই সে পথ চিনে এগোতে থাকলো । একসময় ভয়ানক বিপদেরও সম্মুখীন হতে হল । পাখির এই গমনের কথা রাক্ষসী মায়া বলে জানতে পেরে
প্রকাণ্ড এক দৈত্যকে অস্ত্রহাতে দ্রুত পাঠিয়ে দিল । দূর থেকে দৈত্যকে দেখতে পেয়ে
পাখি মন্ত্রীকে সাবধান করে দিল । মন্ত্রীও তার তরোয়াল বের করে যুদ্ধের প্রস্তুতি
নিল । পাখি এবার বলল, “না বন্ধু, ওই দৈত্য প্রকাণ্ড শক্তিশালী, মায়া বলে তৈরি । মানুষের শক্তি নেই ওর সাথে
লড়াই করার । যা করার আমিই করব ।” এই বলে পাখি তার ঠোঁট ঐশ্বরিক শক্তি বলে বহুগুণ বৃদ্ধি আর ধারালো করে নিল । তারপর মেঘের গর্জনসম
হুঙ্কারে দৈত্য কাছে আসতেই শুরু হলো ভয়ানক যুদ্ধ । প্রথমে কিছুটা
পরাস্ত হলেও পাখি তার ইস্ট
দেবতাকে স্মরণ করলো । এক অদ্ভুত আলোকরশ্মি ঠোঁটে এসে পড়ল , আর তা ঝলমলিয়ে উঠলো । দৈত্যও
তার দীর্ঘ কুঠার উঁচিয়ে এগিয়ে এলো । এ যুদ্ধ আরো ভয়ানক । অবশেষে পাখির ঠোঁটের এক কামড়ে দৈত্যের কুঠারসহ হাত
ছিন্ন হয়ে গেল । প্রচন্ড চিৎকারে দৈত্য
ভূপতিত হল ।
নিশুতি প্রহরে পাখি গিয়ে পৌঁছালো বৃক্ষের গোড়ায় । মন্ত্রী দেখতে পেল মায়াবী
অট্টালিকা । বৃক্ষ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল মন্ত্রী আর সন্ন্যাসীকে । জিজ্ঞেস করল, “কি রে বাছা ,তোরা এখানে কেন এসেছিস?” মন্ত্রী তার মনের কথা খুলে বললেন। সব শুনে বৃক্ষ বলল,” তুই যার খোঁজে
এসেছিস সে তো তোর কাছেই আছে । রাজপুত্র নীলমণি আমার কাছে আছে,কই
দেখতে পাচ্ছি না তো ?” “ পাবি
পাবি, পাখিতো তোকে সব কথাই বলেছে। আমার ডালে
আছে স্মৃতি-সঞ্জীবন লতা, ওই চেয়ে দ্যাখ
। ওর পাতার রস সন্ন্যাসীকে পান করা, তোর ইচ্ছা পূরণ হবে ।”
পাখি ইতিমধ্যে রস নিয়ে এসে হাজির । বলল, “বন্ধু,
রসটা তুমি সন্ন্যাসীকে পান করাও ।” মন্ত্রী দেরি না করে সন্ন্যাসীর মুখে রসটা ঢেলে দিল । সন্ন্যাসী প্রথমে জ্ঞান হারালো, তারপর ধীরে ধীরে চোখ মেলে
তাকালো । বৃক্ষ এবার মন্ত্রীকে বলল,
“একটু
বাদেই ওর স্মৃতি ফিরে আসবে, কিন্তু তার আগে
ওকে ওই লতা গাছে সুন্দর সুন্দর ফল ধরে আছে,
একটা ফল পেড়ে এনে খাওয়াতে হবে । আর তাতে ও
ফিরে পাবে ওর পূর্ব চেহারা । পূর্ব চেহারা ফিরে এলেই ওর সব কিছু
মনে পড়ে যাবে ।”
বৃক্ষের কথামতোই পাখি একটা ফল ছিঁড়ে মন্ত্রীর সামনে ফেলে
দিল । মন্ত্রী সেই ফলটা কেটে সন্ন্যাসীকে খাইয়ে দিল । অমনি সন্ন্যাসী তার পূর্ব চেহারায় ফিরতে লাগলো । মন্ত্রী অবাক । এ কি ! এ তো আমাদের রাজপুত্র নীলমণি । নীলমণিও কথা বলতে
লাগলো । “মন্ত্রী মশাই, এ আমি কোথায়
এসেছি, কীভাবে এসেছি?………..?” নীলমণি তখন দেশে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করল ।
মন্ত্রীর মন খুশিতে ভরে উঠল ।
বৃক্ষ বলে উঠলো, “না রাজপুত্র নীলমণি, এখনই তোমাদের দেশে ফেরা হবে না । আরেকটু
অপেক্ষা করতে হবে । ওই যে দেখছো মায়াবী অট্টালিকা, ওটা এক ভয়ানক রাক্ষসীর নিবাস । রাত এখন চতুর্থ প্রহরে ।
প্রায় ভোর হয়ে আসছে। রাক্ষসীর এখন তার মাকে নিয়ে ঘরে
ফেরার সময় । ফিরে এসেই ওরা গভীর নিদ্রায় ডুবে যাবে । তার আগে তোমরা পা বাড়ালেই
বিপদ । অবশ্য আমার এই ছত্রছায়ায় তোমরা
যতক্ষণ আছো কোন বিপদ নেই । রাক্ষসী এই গন্ডির মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না ।”
এমনসময় অট্টালিকার ছাদ হতে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো । মন্ত্রী বুঝল – পাখি
এক রাজকন্যার কথা বলেছিল, সে–ই বুঝি
কাঁদছে । পাখিও চোখের জলে কাঁদতে লাগলো । মন্ত্রী বৃক্ষকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে ওই রাজকন্যা, তুমি চেনো কি?” “ আলবাত চিনি,
তবে
সেকথা পরে হবে । তোমরা এখন একটু চুপটি করে বসো । রাক্ষসী তার মাকে নিয়ে ফিরে এসেছে , ওই
রাজকন্যার উপর অত্যাচার করছে ।
প্রতিদিনই এমন অত্যাচার করে,
তারপর
ঘুমিয়ে পড়ে ।“
কান্নার আওয়াজ থেমে গিয়ে বিষাদ সংগীতের সুর ভেসে আসছে । বৃক্ষ বলল, “রাক্ষসী আর তার মা ঘুমিয়ে পড়েছে । রাজকন্যা
গাইছে তার জীবনের মর্মগাঁথা । এখন ওই লতানো গাছের একটা ফল নিয়ে
গিয়ে ওই রাজকন্যাকে খাওয়াতে হবে ।” মন্ত্রী জানতে চাইল,“কেন বৃক্ষ?” “রাক্ষসী
রাজকন্যাকে দাসির রূপে বদল করে রেখেছে । ওই ফল খাওয়ালে নীলমণির মতোই রাজকন্যা
তার আসল রূপ ফিরে পাবে । আর তখনই তার সম্বন্ধে যা বলার বলব ।” পাখি বলল, “এ আর কঠিন কী? যাই,
আমি
একটা ফল নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিয়ে আসি ।” বৃক্ষ বলল, “না, তা হবে না । কোন রাজপুত্র যদি ওই ফল রাজকন্যাকে
খাওয়ায় তবেই সে আসল রূপ ফিরে
পাবে ।” পাখি হেসে উঠে বলল, “সেটাই বা কঠিন কী? নীলমণি, তুমি
আমার পিঠে চেপে বসো, আমি ফল আর তোমাকে নিয়ে রাজকন্যার কাছে নিয়ে
যাচ্ছি ।” বৃক্ষ আবার বলে উঠল,
“যাও, তাড়াতাড়ি করো, আর মাত্র কয়েক দন্ড রাত আছে । এর মধ্যেই ফল
খাওয়াতে হবে, না হলে
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মায়াবী অট্টালিকা,
রাজকন্যা অদৃশ্য হয়ে যাবে ।”
পাখি ফল আর নীলমণিকে নিয়ে দ্রুত উড়ে গেল অট্টালিকার ছাদে । রাজপুত্র ফল নিজের হাতে খাইয়ে
দিলো রাজকন্যাকে । রাজকন্যাও ফিরে পেল তার আসল রূপ । সত্যিই এক অপরূপা । পাখি নীলমণি আর অপরূপ
রাজকন্যাকে নিয়ে এসে হাজির হলো বৃক্ষের কাছে। বৃক্ষ তখন
মন্ত্রীকে বলল, “ বাছা, এ হল
সুখনগরের রাজা সুশোভনের একমাত্র কন্যা নীলাঞ্জনা ।”
মন্ত্রীমশাই এবার আরো খুশি । সুখনগরের রাজকন্যাকেও তিনি খুঁজে পেলেন। সূর্য উঠেছে। মায়াবী অট্টালিকা অদৃশ্য হয়েছে । এবার তিনি বিদায় চাইলেন বৃক্ষ আর পাখির কাছে ।
বিদায়ের কথা শুনে বৃক্ষ আর পাখির মুখমণ্ডল ম্লান হয়ে এলো । বৃক্ষ বলল, “বাছা,
বহু
ঘটনার সাক্ষী আমি । নীলমণি আর নীলাঞ্জনার
ভবিতব্যের কথাও আমি জানি । সেই ভবিতব্যে লেখা আছে –– ওদের দুজনের মিলন হবে
এক পুণ্যপ্রভাতে আমার এই ছায়াতলে। সেই শুভদিন যে আজই ।”
মন্ত্রী সম্মতি দিলেন । দুজনের বিয়ে সম্পন্ন হল
বৃক্ষ, পাখি আর ইস্ট দেবতাকে সাক্ষী
রেখে । এরপর বিদায়ের পালা । মন্ত্রী রাজপুত্র আর রাজকন্যাকে নিয়ে ফিরে এলেন রূপনগরে । রূপনগরে
তখন বইতে লাগলো সুখের দখিনা বাতাস ।