ছোটগল্প | |
ট্রাফিক পুলিশ | – হরবিলাস সরকার |
ভূপতিবাবু বৈশাখের তীব্র দাবদাহের মধ্যে বাধ্য হয়ে পথে বেরিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, লালদিঘি মেডিকেল সেন্টারে রক্তের নমুনাটা দিয়েই ফিরে আসবেন। সকালের সূর্য তখনই যেন আগুনের গোলা। তাপমাত্রা ছিল বিয়াল্লিশ ডিগ্রির উপর। ছাতা হাতে নেতাজি মোড় থেকে একটা টোটো রিক্সা ধরে রানিবাগান মোড়ে এসে নেমে পড়লেন। এক গ্লাস আখের রস খেয়ে মনস্থির করলেন, বাকি পথটুকু হেঁটেই যাবেন।
হাঁটা তো শরীরচর্চাই। সেই মতোই রওনা দিলেন। সামনে জাতীয় সড়ক আর শহরের রাস্তার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা ট্রাফিক পুলিশ মানুষ ও যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছিল। নিপুণ দক্ষতার সাথে প্রয়োজন মতো ডান হাত, বাঁ-হাত তুলে বাঁশি বাজিয়ে মেয়েটি কর্তব্য পালন করছিল। ঘর্মাক্ত ভূপতিবাবু কিছু একটা ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হতে গিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। মেয়েটি নিমেষে তীব্র হুইসেল বাজিয়ে ছুটে এসে বয়স্ক মানুষটিকে দু’হাতে ধরে তুলল।
মানুষটির কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল। মেয়েটি চটজলদি নিজের কোমরে গোঁজা রুমাল দিয়ে রক্ত মুছে দিয়ে তাকে সাবধানে সড়ক পার করে এনে ফুটপথে এক বিস্তীর্ণ অশ্বত্থ গাছের নিচে বেদিতে বসাল। বলল, জ্যাঠামশাই, এই আবহাওয়ার মধ্যে, তা আবার একা, পথে বেরিয়েছেন কেন? মা নিতান্ত বাধ্য হয়েই একা বেরিয়েছি।
মেয়েটির সহযোগী ছেলে পুলিশটি ততক্ষণে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে লাগলো। এদিকে মেয়েটি তার পিতৃতুল্য মানুষটির শুশ্রূষা করতে লাগলো। জানতে চাইল, বাড়িতে আপনার কে কে আছে? মাগো, তোমার জেঠিমা আছে। বাতের ব্যথায় নড়তে-চড়তে পারে না। আমিও অসুস্থ। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলাম। সবে অবসর নিয়েছি। ছেলেমেয়ে কেউ নেই? আছে, এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেটা বি.টেক পাশ করে টোটো রিক্সা চালায়। সেই সকালে বেরোয়, ফেরে সন্ধ্যার পরে। কী আর করবে বলো! এ রাজ্যে কাজ নেই। বাইরে দশ-বারো হাজার টাকা মাইনেয় একটা চাকরি পেয়েছিল। একটা ছেলে বলে আমরাই পাঠাইনি। মেয়েটা তোমারই মতো, ছেলের তিন বছরের ছোট। মাস দু’য়েক হল বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। তা তোমার কথা তো জানা হলো না মা।
হ্যাঁ বলছি। তার আগে আপনাকে বলি, আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনার ছাত্রী ছিলাম। শ্রীময়ী মন্ডল। বাড়ি দেবীদাসপুরে। আমার বাবা নেই। মা বেঁচে আছেন। ভাই-বোন বলতে দাদা আর আমি। দাদা ভিন রাজ্যে রাজমিস্ত্রির কাজে গেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিল। হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় দাদাই সংসারের হাল ধরেছিল। আমি বি.এ পাস করেছি। কষ্ট করে ডি.এল.এড প্রশিক্ষণটাও নিয়েছিলাম। শিক্ষিকা হবার স্বপ্ন ছিল। টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছিলাম। ইন্টারভিউয়ে ডাক পাইনি। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস, বলতে পারেন।
এই চাকরিটা পেলে কী করে? জীবনযুদ্ধে সেও ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। আমার বাবা বেঁচে থাকতে বলেছিলেন, কোন কাজই ছোট নয়। সেই কথাটাকেই বেদবাক্য মনে করে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগিয়ে চলতে থাকলাম। এই চাকরিটা জুটল। স্যারের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে শ্রীময়ী এবার বলল, আমার জীবন সার্থক স্যার। যা পেয়েছি, তাতেই আমি খুশি। আর বেশি কিছু চাই না।
ভূপতিবাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। উপরের দিকে তাকিয়ে এবার বললেন, এই গাছটা কত মানুষকে ছায়া দেয়। কত পাখপাখালি এসে ওর শাখা-প্রশাখায় আশ্রয় নেয়, বাসা বাঁধে। তোমরাও বুঝি এখানে বিশ্রাম নাও মা? হ্যাঁ স্যার। ভূপতিবাবু মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ভালো থেকো মা, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন’। তারপর ছাতা মাথায় আবার গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে লাগলেন।
শ্রীময়ী পুনরায় নিজের কাজে মন দিল। মনে অদম্য প্রেরণা। স্যার এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেয়ে বুঝি ধন্য হয়ে উঠেছে। ওকে বেশ সাবলীল দেখাচ্ছে।
দিনের পর দিন কাজের প্রতি নিষ্ঠা আরও বেড়ে গেল। ভদ্রলোকেরা ওর সাহস, দক্ষতা, একাগ্রতা দেখে অভিভূত হয়।
বর্ষার দিনগুলোতে বর্ষাতি পরে উৎসাহে নেমে পড়ে কাজে। মুষলধারে বৃষ্টিও নিরুৎসাহ করতে পারে না। সড়ক, যানবাহন, মানুষ, সর্বোপরি বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির সাথে ওর বুঝি হৃদয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ পরিদর্শনে এসে ওকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়। শ্রীময়ী কি শ্রীহীন হতে পারে? রূপে-গুণে পরিপূর্ণ, স্লিম চেহারার মেয়েটির দিকে অনেকে বাঁকা নজরেও তাকায়। কিন্তু নির্মল শরীর, মন সেসবের প্রতি উদাসীন। কোন মলিনতাই ওকে ছুঁতে পারে না। পাশাপাশি কর্তব্যে, মনুষ্যত্ববোধে ভারী কঠোর। অসাধু, দুর্জনেরা হাত বাড়িয়ে টাকা দিতে চাইলে বিনিময়ে উচিত শিক্ষা পায়।
পৌষের এক কনকনে শীতের সকালে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শ্রীময়ী অসীম সাহসের সাথে এক দুঃসাধ্য কাজকে সফল করে কীর্তি স্থাপন করল। সেকথা খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হল। সাড়া জাগানো কাজের মূল্যও পেল। পদোন্নতি হয়েছে।
মাঘের শেষ দিকে ভূপতিবাবু আবারও শহরে এলেন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে। শীতে জবুথবু অবস্থায় ওই বড় গাছটার নিচে বেদিতে এসে বসলেন। আজ অন্য একটি মেয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছিল। ভূপতিবাবুর মন খারাপ হয়ে গেল। দেখা হবে না মেয়েটার সাথে! মনটা বড়ই টানছিল। কাকতালীয় না অন্য কিছু? হৃদয়ের এই আকুতি হয়তো ঈশ্বরও শুনেছেন।
শ্রীময়ী আজ ছুটি নিয়েছিল। তবুও একটা বিশেষ কাজে এসেছে। স্যারকে দেখামাত্রই কাছে এসে তাঁর পায়ের ধুলো মাথায় নিল। ভালো আছো মা? হ্যাঁ স্যার। প্রায় এক বছর পর আপনার সাথে দেখা হল। কিন্তু স্যার, আপনার শরীর তো ভেঙে গেছে। মা রে, বয়স হয়েছে। যাকগে, আমার কথা ছাড়ো, আজ আমি তোমার কথাই শুনব।
স্যার, একটা নিদারুণ দুঃখের খবর আছে। আজ এক মাস দু’দিন, আমার দাদা মুম্বাইয়ে একটা বহুতলের ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। মায়ের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। শোকে-দুঃখে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। ছেলের মৃত্যু তার কাছে অবিশ্বাস্য। শুধু বলে, আমার বিশ্বম্ভর কবে ফিরবে? দাদার নাম বিশ্বম্ভর, স্যার। মাগো, বুঝি তোমার মায়ের অবস্থা কী। এসময় তুমিই তোমার মায়ের একমাত্র সান্ত্বনা। শোক,দুঃখ যাই থাকুক, তোমাকে নিজেকে শক্ত হয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াতে হবে।
কথাগুলো শ্রীময়ীর মনকে ছুঁয়ে যায়। স্যার, পরজন্মে আমি যেন আপনার মেয়ে হয়ে জন্মাই। আজ আপনাকে সব কথাই বলবো। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে আমার জীবন শুরু হয়েছিল। অপ্রিয় সত্য হলেও বলি। এখন আমাকে আরও অনেক দুঃখ-ব্যথা, অপমান, ব্যঙ্গ, উপহাস সইতে হয়। ঘৃণা কুড়োতে হয়। উপরের হুকুম অনেক ক্ষেত্রে মন না চাইলেও মেনে নিতে হয়। ন্যায়-অন্যায় বোধে আঘাত লাগলেও কিছু করার থাকে না। বকাটে ছেলেদের কুকথা, অশোভন ইঙ্গিত দেখে-শুনেও না দেখা, না শোনার ভান করে চলতে হয়। তবে এত সব যন্ত্রণা সইতে সইতে ভেতরটা শক্ত হয়ে গেছে।
মা, তুমি নিজেও জানো, সমাজ পুলিশকে কী চোখে দেখে। জানি স্যার। আসলে মন্দটাই মানুষের চোখে পড়ে। ভাল যা কিছু মন্দের চাদরে ঢাকা পড়ে যায়। সারাবছর আমরা ঝড়-জলে ভিজি, রোদে পুড়ি, ধূলো মাখি, বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিই। তাতে কারও মনে এতটুকুও ব্যথার সৃষ্টি করে না। অবশ্য তারও কারণ আছে। আমাদের অনেকেরই হৃদয়হীনতা, নির্লজ্জ লোভ-লালসা এর জন্য দায়ী। অন্যায়-অধর্মের কাজে নিজেকে আত্মসমর্পণ করা, এসবের জন্যই ভদ্র সমাজে আমরা অতি নিকৃষ্ট। আমরা বড়ই নিরুপায়। শেকলে বাঁধা। ভালো-মন্দ, ন্যায় বিচারের সুযোগ থাকে না।
কিন্তু মা, তোমার চোখে-মুখে তো সেসব দুঃখের কোন ছায়া দেখতে পাই না। ওই যে বললাম স্যার, ভেতরে সইতে সইতে সব সয়ে গেছে। আমি ওসব নিয়ে ভাবিও না। মাথা উঁচু করে আমি আমার কাজ করে যাই। তাহলে এক টুকরো গল্প বলি, শুনুন স্যার।
“সেদিন পৌষের এক সকাল। চারদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা ছিল। এই চৌরাস্তার মোড়েই ডিউটি করছিলাম। থানার ওসি সাহেব মোবাইল ফোনে আমাকে জরুরি একটা খবর পাঠালেন। আমি অত্যন্ত সতর্ক হয়ে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেলার সর্বোচ্চ কর্মকর্তা ফোনে আমাকে সাবধান করলেন, সন্দেহজনক কিছু দেখলে চোখ বুজে থেকো, যদি চাকরিটা হারাতে না চাও। হঠাৎ ইলেকট্রনিক সিগন্যালও অকেজো হয়ে গেল। তবে কি সততাকে জলাঞ্জলি দিয়ে অসৎ পথেরই পথিক হব? বিবেক আমাকে কর্তব্যবোধের কথা মনে করিয়ে দিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই লক্ষ্য করলাম – ওসি সাহেবের বিবরণ অনুযায়ী নীল-সাদা আলো জ্বেলে একটা গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে। সন্দেহটা নিশ্চিত হতেই টর্চে লাল আলো জ্বেলে রাস্তা আটকে প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। গাড়িটা একেবারে কাছে এসে থেমে গেল। আমি গাড়িটাকে পাশের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াতে বললাম। শুনল না। কালো কোট, কালো টুপি, কালো চশমা পরা দু’জন যুবক এক বান্ডিল নোট হাতে নেমে এলো। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা রাখুন। গাড়িটা ছেড়ে দিন। আমি বললাম, টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে নিন। গাড়ি চেকিং হবে।
বলো। তারপর কী হলো?
ওরা আমাকে আগ্নেয়াস্ত্র উচিয়ে বলল, তাহলে তুই নিজের বিপদ ডেকে আনছিস? আমি সত্যিই বুঝলাম, বিপদ আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তবু সাহসে ভর করে দ্রুত একটা উপায় খুঁজতে লাগলাম। সামনে-পেছনে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। ঘন ঘন হর্ন বাজছে। দুষ্কৃতীদের ট্রিগারে চাপ দেবার আগেই মিছেমিছি চিৎকার করে বললাম, ফোর্স,গেট রেডি ফর অ্যাকশন। হতচকিত হয়ে দুষ্কৃতীরা এক ধাপ পিছিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে ইচ্ছে করে একটা ভুল করলাম। লাল আলো নিভিয়ে সবুজ আলো জ্বেলে দিলাম। অথচ উল্টো দিকের যান চলাচল বন্ধ করলাম না। ওদিকে যুবকেরা সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্রই লাফিয়ে গাড়িতে উঠে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝল না, আমি কী ফাঁদ পেতেছি। নিমেষে যানজট সৃষ্টি হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ওসি সাহেবও ফোর্স নিয়ে এসে পড়েছেন। গাড়ি সমেত দুষ্কৃতীদের আটক করা হলো।
কী ছিল গাড়িতে?
দু’কোটির বেশি নগদ টাকা, বিপুল বিষ্ফোরক এবং আগ্নেয়াস্ত্র।
তুমি তো জীবনকে বাজি রেখে অসম্ভবকে সম্ভব করেছো, মা শ্রীময়ী। সাহস এবং সততার প্রতীক হয়ে দেশকে বিরাট কোন অঘটন থেকে রক্ষা করেছো। প্রার্থনা করি, তোমার মতো মেয়ের জন্ম হোক ঘরে ঘরে।
একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি স্যার। রাজ্যের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমার কাজে খুশি হয়ে আমাকে হেড কনস্টেবল পদে উন্নীত করেছেন।
ভূপতিবাবুর মুখখানা খুশিতে ভরে উঠল। তোমাকে আমারও একটা সুখবর দেবার আছে। আমার ছেলে এখন চার চাকার একটা গাড়ি কিনে চালাচ্ছে। আরও নিশ্চয়ই খুশি হবে, আমি মনস্থির করেছি, তোমাদের বাড়ি একদিন যাবো। তোমার মাকে দেখে আসবো।
শ্রীময়ী সীমাহীন আনন্দে আবারও ভূপতিবাবুর পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে বলল, আমি আপনার পথ চেয়ে থাকবো।
……………………………………………………….