Andher Drishti – অন্ধের দৃষ্টি

অণুগল্প
অন্ধের দৃষ্টি  –  হরবিলাস সরকার
অন্ধ কানাই জন্ম থেকেই দু’চোখে দেখতে পায় না। গরিবের ছেলে। পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে। অভাগিনী মা ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে পারেনি। দশ কিমি দূরে শহরে অন্ধদের স্কুলে ভর্তি করে লেখাপড়া শেখানো তার সাধ্যের বাইরে ছিল।
বছর পনেরো যখন বয়স, তখন কানাইয়ের মা-ও হঠাৎ দু’দিনের জ্বরে মরে গেল। কানাই বড় একা হয়ে গেল। তবে ঈশ্বরের দয়ায় সে গলায় সুর পেয়েছিল। মায়ের হাত ধরে এ গ্রাম, ও গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে পথঘাটও বড় চেনা হয়ে গিয়েছিল। এখন একাই বাঁশের একটা লাঠি সম্বল করে বেরিয়ে পড়ে, আর গান গেয়ে ভিক্ষা করে। পাড়ার আরতি মাসি সকাল, সন্ধ্যা দুমুঠো চাল ফুটিয়ে দেয়। ওতেই চলে যায় কানাইয়ের।
বছর কুড়ি বয়স হলো যখন, আরতি মাসি একদিন বলল, কানাই রে, আমি আর তোরে রেঁধে দিতে পারব না। কানাই কেঁদে ভাসাতে লাগল। মাসি গো, মা চলে যাবার পর তোমাকেই মা বলে জেনেছিলাম। এখন যদি তুমিও …….. ! না রে হতভাগা, আমি তোরে ছেড়ে চলে যাচ্ছি না। শোন্, আমার এক দূর সম্পর্কের ভাইঝি আছে। বোবা, গায়ের রং কালো। তবে কান দু’খান টনটনে, চোখের দৃষ্টি প্রখর, আর কাজে-কামে এক্কেবারে পটু। নাম লক্ষ্মী। সত্যিই লক্ষ্মীমেয়ে। তুই যদি মত দিস, ওরে আমি তোর ঘরে নিয়ে আসতে পারি। তোর ভবিষ্যৎ ভালোই হবে। কানাই একগাল হেসে বলল, মাসি, তুমি যদি ভালো মনে করো, আমার তাতে অমত নেই।
পাড়ার মন্দিরে কানাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল ধুমধাম করে। বোবা, কালো বউ এখন কানাইয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী। দুঃখ-সুখ একে-অপরে সমানভাবে ভাগ করে নেয়। একদিন পথে চলতে চলতে কানাইয়ের কী মনে হল, জিজ্ঞেস করল, লক্ষ্মী, তোমার খুব কষ্ট হয়, তাই না?
 লক্ষ্মীর কাজল কালো মুখখানা নিমেষে আরও নিকষ কালো হয়ে গেল। চোখে জল এলো। স্পর্শের মাধ্যমে নানা আকার ইঙ্গিতে, অস্ফুট স্বরে কত কিছু বলে দিল। কানাই বোঝে লক্ষ্মীর অন্তরের কথা। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে লাগলো, জানি, তুমি কী বলেছো। তুমি বলেছো, না গো, এ তুমি কী বলছো? অমন কথা আর কখনও মুখেও আনবে না। বড় কপাল করে তোমার মত স্বামী পেয়েছি। তোমার সাথে সারাদিন ঘুরে বেড়াই, কত নতুন জায়গা, নতুন নতুন মানুষ দেখতে পাই। কত বাড়িঘর, মাঠঘাট, সবুজ খেত দেখতে পাই। আনন্দে আমার মন ভরে ওঠে। আর তোমার গানের সুর আমাকে যে পাগল করে দেয়।
লক্ষ্মী মন খুলে খিলখিল করে হেসে ওঠে। তারপর স্বামীর বাঁ হাতখানা তুলে নিয়ে আদরে-সোহাগে, আকার-ইঙ্গিতে একটা খুশির খবর দিল। কানাইও উদ্দাম উচ্ছ্বাসে হেসে উঠলো। বুঝেছি, তুমি বলেছো, আমাদের কুঁড়েঘর আলো করে আমাদের বংশধর আসছে। তোমার কথা যেন সত্যি হয় লক্ষ্মী।
কিন্তু লক্ষ্মী এবার অঝোরে কেঁদে উঠলো। তার কন্ঠের না ফোঁটা কত কথা কানাইয়ের হৃদয়তন্ত্রীর তারে বেজে উঠল। কেঁদো না লক্ষ্মী। তুমি আমাকে বলতে চেয়েছো, এই সুন্দর পৃথিবীর কোন কিছুই তুমি তো দু’চোখ ভরে দেখতে পাও না। আমাদের ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, তাকেও তো দেখতে পাবে না। লক্ষ্মী, কে বলে আমি দেখতে পাই না? তোমার দু’চোখ দিয়ে আমি যে সবকিছুই দেখতে পাই। যে আসছে, তাকেও আমি তোমার দু’চোখ দিয়েই দেখবো।

Leave a Comment