ছোটগল্প | |
জীবনের দাম | – হরবিলাস সরকার |
রূপের সৌন্দর্য আর প্রাণ ভোলানো সুরের মেলবন্ধনে এসেছিল প্রেম।
এক নিঝুম রাতে দু’পার থেকে দুজনেই সে প্রেম নিবেদন করেছিল। তপতী, তোমার গানের ভুবনে আমি যে এক উৎসুক শ্রোতা। তুমি আছো অনেক দূরে, যেন সীমাহীন এক সাগরের ওপারে। তবু মনে হয়, তুমি আমার পাশে বসেই সুরের ঝংকার তুলেছো আমার হৃদয়বীণার তারে।
নীলাম্বর, তোমার সুন্দর মুখের কথাগুলো কবিতার মতো। যা আমার ভেতরকে উদ্দাম সাগরের ঢেউয়ের মতো উথাল-পাথাল করে দেয়। কী অদ্ভুত সৃষ্টি! এই নিশুতির প্রহরে আমিও এখন সীমাহীন সাগরের এপ্রান্ত থেকে তাকিয়ে আছি। মনে হয় তুমি লিখে চলেছো উদাসী কবিতা—
“ সাগর, তুমি অসীম, তবু অসীমেরও সীমা আছে। আমি সেই সীমানায় পৌঁছাতে চাই। সে আমার জীবনের নতুন ভুবন। সেখানে প্রস্ফুটিত গোলাপের পাপড়িরা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। মনে হয় পৌঁছে গেছি। নিরলে ফুলশয্যায় বসে এখন দু’জনের কত কথা হবে!”
তপতী, আমিও শুনতে পাচ্ছি তোমার নতুন গানের সুর। জ্যোৎস্নালোকিত রাতের আকাশে অনুরণিত হয়ে চলেছে – – –
“ জীবনের দাম দিওনা আমায়, মন ছাড়া আমি যে আর চাইনা কিছুই। হিরে-মানিক অনেক দামি, তার চেয়েও বেশি দামি তুমি। সেইতো আমার উপহার।- – – – – – – – – – – -।”
না তপতী, আমার জীবনের দাম কতটা, আমি জানি না। তবে আমি বলবো, তোমার জীবনের দাম হীরে-মানিকের চেয়েও বেশি।
সেই দাম আমি চাই না। শুধু কথা দাও, যা চাইবো, তুমি দেবে?
নিশ্চয়ই দেবো। বলো তবে, তুমি কী চাও। ওগো আমার প্রিয়তম, আমি শুধুই তোমাকে চাই।
বেশ, পূর্ণিমার চাঁদকে সাক্ষী রেখে কথা দিলাম।
নীলাম্বর, আজ আমি সত্যিই আমার জীবনের দাম পেয়ে গেলাম। ওগো রাতজাগা পেঁচা, দেবতা আমার, ভোর হয়ে এলো বুঝি, এবার ঘুমিয়ে পড়।
ও আমার রজনীগন্ধা, তুমিও ঘুমিয়ে পড়।
একদিন তপতী জানতে পারলো, এক প্রভাবশালী মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে নীলাম্বর। আনন্দের মাঝেও ভয় ধরে মনে। খবরটা বাড়িতে জানাজানি হয়। তপতীর মা-বাবা, ভাই এমন মেলামেশায় নিষেধ করে। মা বোঝায়, তপতী, মা রে,তোর বাবা সামান্য কেরানির চাকরি করে। বড়লোকের চাহিদা আমরা মেটাতে পারবো না। কিন্তু মা,আমরা যে দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে ফেলেছি। ভালোবাসা না অভিনয়, বুঝবি কী করে ? যে ছেলে মনে করে, হীরে মানিকের চেয়েও আমার জীবনের দাম অনেক বেশি, সে কি অভিনয় করতে পারে, মা? ছদ্মবেশীদের চেনা কি সহজ? মন উজাড় করে অনেক কথা বলে, অসৎ উদ্দেশ্যটা গোপন রাখে।
মায়ের কথায় তপতীর দুশ্চিন্তা হয়। কিন্তু যে মন দিয়ে ফেলেছে, সে মন ফেরাবে কী করে!
ওদিকে মন্ত্রীর ঘরে ওঠাবসা ব্যবসায়ী পরিবারের। সম্প্রতি মন্ত্রী-কন্যা ‘তনয়া’র প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে নীলাম্বর। ভুলতে লাগল তপতীকে। দিনে দিনে আভিজাত্য আর ভোগবিলাসের মোহ নীলাম্বরকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। উচ্ছৃঙ্খলতা বাসা বেঁধেছে মনে।
তবে তনয়ার জীবনে আভিজাত্যের ছোঁয়া থাকলেও উচ্ছৃঙ্খলতা তাকে ছুঁতে পারেনি। সে যে ভালোবেসেই নীলাম্বরের ঘরনি হতে চায়। সেই ইচ্ছেতেই আষাঢ়ের এক রিমঝিম বৃষ্টির দিনে দীঘায় বেড়াতে গেল প্রিয়তমকে নিয়ে।
জাঁকজমকপূর্ণ এক হোটেলের বদ্ধঘরে মদের বোতল নিয়ে বসল নীলাম্বর। অনিচ্ছায় হলেও সামান্য মদ্যপান করতে হল তনয়াকে। তাতে হবু জীবনসঙ্গীর লাগামহীন মদ্যপানের নেশা কিছুটা নিবৃত্ত করতে পারল বটে, কিন্তু উত্তেজিত শরীরের অতি প্রবল ক্ষুধা শত বল প্রয়োগ করেও নিবৃত্ত করতে পারল না।
এরপরও নীলাম্বর তনয়ার মুখে চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল, ভুল বুঝনা প্রিয়তমা। ভোগের দুনিয়ায় এমনটাই তো স্বাভাবিক। এই যে আমরা বিয়ের আগেই লিভ টুগেদার করছি, এ তে অন্যায় কোথায়? পশ্চিমী দুনিয়ার মতো আমাদের দেশেও এখন বৈধ।
ছি! নীলাম্বর, এতটা নিচ, পাশবিক তুমি! তোমাকে বিশ্বাস করে বড় ভুল করে ফেলেছি আমি। এই বুঝি আমার ভাগ্যে লেখা ছিল! ক্ষত-বিক্ষত মনকে এভাবেই সান্ত্বনা দিয়ে লজ্জায়, ঘৃণায় নীলাম্বরের সাথে সব বন্ধন ছিন্ন করে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এলো তনয়া। একাকী রওনা দিল কোলকাতার উদ্দেশ্যে।
নীলাম্বরও বাড়ি ফিরে এলো। শরীর মন্থনের স্বাদ যে নরপিশাচ একবার পেয়ে গেছে, শরীরকে না পাওয়ার শূন্যতায় সে আরও বেশি উন্মাদ হয়ে উঠেছে। চাই তার নতুন শিকার।
এদিকে তপতী আজও পথচেয়ে বসে আছে। স্বপ্নের মতো ভেসে আসে নীলাম্বরের কন্ঠস্বর। মা তাকে বোঝায়, মরীচিকার পিছনে ছুটে তুই তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিলি মা! গানের মাস্টারমশায়ও তোর অবনতির কথা বলছেন। গান এখন থাক্ মা, আগে আমাকে আমার হিসেবটা বুঝে নিতে দাও।
মাঘী পূর্ণিমার আগের দিন বিকেলে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভিডিও কল এলো নিলাম্বরের। দুঃখের সাগরে অনাবিল আনন্দের ঢেউ যেন উথাল-পাথাল করে দিল। অশ্রুসজল নয়নে সাড়া দিল তপতী, কেন এত আঘাত দিলে? এভাবে আমাকে জীবনের দাম দিলে?
আবেগময় কন্ঠে উত্তর এলো, আমাকে ভুল বুঝনা তপতী। খুব ব্যস্ত ছিলাম। যদি অন্যায় করে থাকি, ক্ষমা করে দিও। আমি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছি। কাল সরস্বতী পুজো। চলে এসো না বেহালায়! আমাদের দু’জনের প্রথম সাক্ষাৎ স্মৃতি হয়ে থাকবে। এতদিন মনের দেখা দেখেছি। এবার চোখের দেখা দেখবো। তুমি আসছো তো? কথা দাও লক্ষ্মীটি।
কথা দিলাম। তৃষিত মনের এমন আকুলতায় নীলাম্বরের উপবাসী শরীর আরও ক্ষুধাতুর হয়ে উঠল। আর তপতীর জীবন নদীতে উত্তাল প্লাবন ধারা বইতে লাগল। তা রুধার সাধ্য আছে কার? পরদিন ভোরে তপতী মাকে ভরসা জুগিয়ে একাকী রওনা হয়ে গেল।
নানা দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র রাত কাটিয়ে ভোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল বাবা। ঘুম ভাঙল যখন, মেয়ের কথা জানতে পেরে মাকে বকাবকি করতে লাগল, কেন যেতে দিলে? পৃথিবীর মাটিতে বসে চাঁদ ধরা যায় না, অলকা। কী করবো! বলো। মেয়ে বড় হয়েছে। ওর ভেতরে একটা মন তৈরি হয়েছে। সেই মনের গতিকে জোর করে থামাতে গেলেও ভয়ংকর বিপদ। সেকথা বুঝেই আপাতত নিজেকে শান্ত করে নিলেন মহেশবাবু। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল। ছোট ভাইটাও দিদির জন্য ভাবছে।
বেলা ১০:৩০ টায় ভাগীরথী এক্সপ্রেস পৌঁছালো শিয়ালদা স্টেশনে। এরপর ছোট গাড়ি করে বেহালা। নির্দিষ্ট স্থানে নীলাম্বর অপেক্ষা করছিল। অসুবিধা হয়নি চিনতে। এতদিন দু’জন দু’জনকে ছবিতে দেখেছে। আজ সামনাসামনি। বাড়িতে ফোন করে জানালো তপতী, মা, ঠিকমতো পৌঁছে গেছি। ওর দেখা পেয়েছি। আর কিছুই বলেনি। তবুও সবারই স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল।
সারাটা দিন দ্বিতীয়বার ফোনের আশায় আশায় কেটে গেল। ফোন আসেনি। ফোন ধরেও নি তপতী। দিনের আলো নিভে গেল। তারপর রাত এক প্রহর হতেই মা উতলা হয়ে উঠল। বাবা বাকরুদ্ধ হলেন। ছোট ভাই কেঁদে ভাসাতে লাগলো।
সারারাত এমনিকরেই কেটে গেল। পরদিন দুপুর পর্যন্ত মেয়ে বাড়ি ফিরল না। বাধ্য হয়ে মা-বাবা থানার দ্বারস্থ হলেন।
চার দিনের মাথায় বস্তাবন্দী তপতীর নিথর দেহ মিলল বেহালা থেকে অনেকটা দূরে, এক জলাশয়ের ধারে।
গোটা রাজ্য তোলপাড় হল। মোমবাতি মিছিল হল। তবু খুনি ধরা পড়ল না। আদালতে নালিশ উঠল। পুলিশের গড়িমসি দেখে আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলেন। নীলাম্বরকে ধরে আনা হলো মুম্বাই থেকে।
কোলহারা মায়ের বুকটা শোকে পাথর হয়ে গেছে। বিচার বিলম্বিত হচ্ছে দেখে নিরুপায় মা ন্যায়বিচারের আশায় স্বামী আর ছোট ছেলেকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হলেন। মূখ্যমন্ত্রী সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আমিও মর্মাহত, দুঃখিত, শোকাহত। যদিও জীবন থাকলে মৃত্যু আসে। কিন্তু এ মৃত্যু কাম্য ছিল না। কথা দিচ্ছি, আপনারা সুবিচার পাবেন।
এরপর নির্ধারিত দিনে মামলার শুনানি আরম্ভ হল। আদালতে সিবিআই অফিসার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেশ করে বললেন, ধর্মাবতার, মেয়েটিকে শারীরিক নির্যাতনের পর গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারীর আসল উদ্দেশ্য ছিল যৌন ক্ষুধা নিবারণ। শেষে প্রমাণ লোপাটের জন্য হত্যা। অভিযুক্ত নীলাম্বরই এই জঘন্য এবং নির্মম কাজটি সম্পন্ন করেছে।
প্রতিপক্ষের উকিল প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, মাই লর্ড, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে। কেননা, এবছর মাঘী পূর্ণিমার দিনাঙ্কটি ছিল চৌঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ সাল। সেদিন তপতী দেবী কোলকাতায় এসেছিলেন এবং ধর্ষিতা হবার পর খুন হয়েছিলেন, একথা সত্য। কিন্তু আমার মক্কেল নীলাম্বর সেদিন কোলকাতাতেই ছিলেন না। তিনি আগের দিন রাত ন’টা পাঁচ মিনিটে মুম্বাই এক্সপ্রেসে চেপে মুম্বাই চলে গিয়েছিলেন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। আমার হাতে এই সেই সংরক্ষিত টিকিট, যার উপর কর্তব্যরত চেকার সাহেবের সই আছে। আর এখন আমি সেই চেকার দিগ্বিজয় চক্রবর্তীকে কাঠগড়ায় ডেকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই।
বিচারকঃ অনুমতি দিলাম।
চেকার সাহেব কাঠগড়া এসে দাঁড়ালেন।
প্রতিপক্ষের উকিলঃ মিস্টার চক্রবর্তী, দেখুনতো, টিকিটের উপর যে সই আছে, সেটি আপনার কিনা?
চেকার সাহেব পরখ করে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এ সই আমার।
প্রতিপক্ষের উকিলঃ মাই লর্ড, ফরেন্সিক ল্যাবরেটরীতেও প্রমাণিত হয়েছে, এ সই মিস্টার চক্রবর্তীর। অতএব, আমার মক্কেল সম্পূর্ণ নির্দোষ।
বাদীপক্ষের উকিল জোরালো প্রতিবাদ করলে বিচারক তা খারিজ করে দিয়ে বললেন, উকিল সাহেব, নীলাম্বর যে সেদিন মুম্বাইয়ে গিয়েছিলেন, তা প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতি কীভাবে সম্ভব?
বাদীপক্ষের উকিলঃ ইওর অনার, নীলাম্বরের উপস্থিতি যে ঘটনাস্থলেই ছিল, তা আমার কথা নয়, বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্ট ডাঃ মৃণাল কান্তি সরকার মহাশয়ের, সিবিআইয়ের তদন্ত সেকথাই বলে। তাই আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, ডাঃ সরকারকে এ বিষয়ে কিছু বলতে অনুমতি দেবার জন্য।
বিচারকঃ ঠিক আছে। ডাঃ মৃনাল কান্তি সরকার কাঠগড়ায় এসে আপনার বক্তব্য রাখুন।
ডাঃ সরকারঃ ধর্মাবতার, তপতীর জন্ম থলিতে যে সিমেন্ট পাওয়া গেছে, তা আমি বিশেষ যত্নের সাথে পরীক্ষা করে দেখেছি। নীলাম্বরের রক্তরস আর ওই সিমেন্টের মধ্যে পাওয়া ডিএনএ হুবহু এক। অর্থাৎ প্রমাণিত যে, সেদিন নীলাম্বর তপতীর সাথে যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হয়েছিল।
বিচারক ধন্দে পড়ে গেলেন এবং সিবিআইকে নিপুনভাবে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে আদালত মুলতবি করে চলে গেলেন।
নীলাম্বরের বাবাও মরীয়া হয়ে উঠলেন ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। দিন কয়েক পর মুখ্যমন্ত্রী নিজে এলেন মৃত নির্যাতিতার বাড়ি। আজ তিনি অশ্রু ঝরালেন। বললেন, যে চলে গেল তার প্রাণ আমরা ফিরিয়ে দিতে পারব না। তবে পরিবারের পাশে আছি। হত্যাকারী কে, যদিও নির্দিষ্ট করে এখনও প্রমাণিত হয়নি। সে যেই হোক, তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবেই। এরপর শোকাহত মায়ের হাতে পাঁচ লক্ষ টাকার একটি ব্যাংক-চেক দিয়ে বললেন, মেয়ের জীবনের দাম দিতে পারব না। তবু এটা দিলাম, রাখুন।
মা দু’হাতে বুক চেপে ধরে বলল, টাকা আমি নিতে পারবো না। মেয়ে আমার বড়ই অভিমানী ছিল। ওর আত্মা শান্তি পাবে না। বলবে, মাগো, জীবনকালে কেউ তো দাম দিলো না। মরণ তবে আশীর্বাদ হয়ে এলো বুঝি। তোমার হতভাগিনী মেয়ের জীবনের দাম পাঁচ লক্ষ টাকা!
দু’দিন পর জানা গেল, আদালতে শুনানির দিন পিছিয়ে গেছে। দিন পিছোতেই থাকল। হতভাগ্য বাবা-মা বারবার বিচারের দরজায় গিয়ে ফিরে এলো। বিচার পেল না।