ছোটগল্প |
ন্যাংড়ার লাথির জোর | – হরবিলাস সরকার |
নান্টু প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মায়নি। দশ বছর বয়সে দূরারোগ্য এক ব্যাধি এসে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল। সেই থেকেই ডান পা-টা ক্রমে সরু, অবশ, বলহীন হয়ে গেছে। অনেক এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি করেও কোন কাজ হয়নি।
অবশেষ হাঁটা-চলায় যখন একেবারেই অপারগ হয়ে উঠল, একটা ক্রাচ তুলে নিলো হাতে। নান্টুর নতুন নামকরণও হয়ে গেল ন্যাংড়া নান্টু। ন্যাংড়া বিশেষণটি যোগ করার আরেকটি কারণও আছে। কেননা, এলাকায় নান্টু নামে প্রায় সমবয়সি আরেকটি ছেলে আছে।
যাইহোক, শহর-ঘেষা গাঁয়ের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির পাঠ কোন রকমে সমাপ্ত করে দুই কিলোমিটার দূরে উচ্চ বিদ্যালয়ে আর যেতে পারেনি ন্যাংড়া নান্টু। পড়াশোনায় ইতি পড়ল। অন্যদিকে সংসারে টানাটানি। বাবাকে সাহায্য করতে এলাকার চৌরাস্তার মোড়ে ন্যাংড়া নান্টু বটবৃক্ষের ছায়াতলে বসে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করে দিল।
বেলা দশটা নাগাদ আসে, ফেরে সূর্যাস্তের আগে। ছেলেটার এই অবস্থা দেখে লোকের দয়া-দাক্ষিণ্যে কোন কার্পণ্য নেই।
বছরের পর বছর কেটে গেছে। পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে একটা হুইল চেয়ারের জন্য বারবার আবেদন করেও ন্যাংড়া নান্টুর ভাগ্যে তা জোটেনি। বরং শেষবার ধমক খেয়ে আর কখনও প্রধানের বাড়ি-মুখো হয়নি নান্টু। সাময়িক মন খারাপ হলেও সে তা বেশিদিন মনে রাখেনি।
এরপর আষাঢ়ের এক বিকেল। আকাশজুড়ে ঘন কালো মেঘ। চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। রাস্তায় কোন লোকজন নেই। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নান্টু বাড়ি ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছিল। কিন্তু রিমঝিম বৃষ্টিও নেমে গেল।
এমনসময় প্রধানের বড় মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে অদূরে একটি টালির চালার নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল। পোশাক দেখে বোঝা গেল – স্কুল থেকেই ফিরছিল। ওই চালার তলায় মাচার উপর যত বকাটে ছেলেদের আড্ডা হয়। এসময় আর কেউ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে পশ্চিমপাড়ার ছেলে লালু, এলাকায় লালুগুন্ডা নামেই খ্যাত, সাইকেলে করে এসে হাজির। মাথায় বাঁধা রুমালটা খুলে হাত-মুখ মুছে নিয়ে মেয়েটার একেবারে কাছে গিয়ে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটা হঠাৎ ইতর, বদমাশ বলে চেঁচিয়ে উঠল। নান্টুর মনে হল – আপত্তিকর কিছু ঘটছে। তাই সে তীক্ষ্ণ নজর দিল। কিন্তু কী করবে, সে নিজেই তো অসহায়! এরপর মেয়েটির গায়ে লালুর হাতের বিশ্রী স্পর্শ পড়তেই সে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল। ধস্তাধস্তিতে তার শরীরের পোশাক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। নিরুপায় মেয়েটা তখন ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে মরণপণ চিৎকার করতে লাগলো। লড়াইয়ে মেয়েটির হার মানতে দেখে নান্টুর পঙ্গু শরীর উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে ভুলে গেল তার অসহায়ের কথা। ক্রাচে ভর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল। ডান হাতে ক্রাচ, বাঁ হাতে লালুর ঘাড় চেপে ধরে রূঢ় মেজাজে বলে উঠলো, ছাড়্ ওকে। পাষণ্ড, আজ তোর একদিন কী আমার একদিন। লালু পেছন ঘুরে এক ঘুসি মারতেই নান্টু পড়ে গেল মাটিতে। কিন্তু ছাড়ার পাত্র নয় নান্টু। দু’হাতে লালুর পা ধরে হ্যাচকা টান মারলে, সামলাতে না পেরে লালুও পড়ে গেল। শুরু হল মল্লযুদ্ধ। মাটিতে ঠেসে ধরে কিল, চড়, ঘুসি, কনুইয়ের গুঁতো চলতে থাকলো নান্টুর উপর। তার নাক, কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। অক্ষম, অসহায়, প্রাণ ওষ্ঠাগত নান্টু ক্ষণিকের মধ্যেই মনের ভেতরে প্রবল শক্তি অনুভব করতে লাগলো। বীরবিক্রমে লালুর দু’হাত বজ্রকঠিন আঁটুনিতে ধরে নিল। অসার ডান পায়ে সামান্যও বল পায় না, এক বিন্দু নাড়াতে পারে না। সেই অসার পা হঠাৎ নড়ে উঠল। নিমেষে এক ঝটকায় সেই পা তুলে লালুর তলপেটে এমন লাথি মারলো, যেন ভারী, কঠিন এক লৌহদণ্ডের প্রবল আঘাত গিয়ে পড়ল। লালু কাবু হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
ওদিকে মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর দু’হাতের তালুতে ক্ষত-বিক্ষত আচ্ছাদন বিহীন শরীর ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে।
ইতিমধ্যে লোকজন ছুটে এসেছে। কেউ থানায়, কেউ প্রধানকে ফোন করল। কেউ কেউ নান্টুর শুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়ে উঠল, আর লালুকে জ্ঞান ফিরলে গাছের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই থানার গাড়ি আর প্রধান এল তাঁর দলবল নিয়ে। বড়বাবু লালুকে নিয়ে চলে গেলেন। প্রধান অশ্রুবর্ষণ করে নান্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি আমার মেয়েকে যে বিপদের হাত থেকে বাঁচালে, আমি তা কোনদিন ভুলবো না। তোমার ঋণ আমি শোধ করতে পারব না, বাবা। তুমি আমার কাছে একটা হুইল চেয়ার চেয়েছিলে, আজই আমি কিনে দেবো। আর কাল থেকে তোমাকে ভিক্ষা করতে হবে না। তুমি হুইল চেয়ারে করে আমার হার্ডওয়ারের দোকানে গিয়ে বসবে। এটা তোমার চাকরি।
নান্টু হাত জোড় করে বলল, না প্রধান সাহেব, বিবেকের তাড়নায় আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। বিনিময়ে আপনার কাছ থেকে কিছু আশা করতে পারি না। এই বটতলায় প্রতিদিন কত মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়, তাঁরা আমাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে। এ আমার কাছে স্বর্গসুখের চেয়েও বড়।
…………………………